بِسمِ اللهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ
الحَمْدُ لله نَحْمَدُهُ وَنَسْتَعِيْنُهُ وَنَسْتَغْفُرُهُ وَنُؤْمِنُ به وَنَتَوَكَّلُ عَلَيْهِ – وَنَعُوذُ بالله من شرور أنْفُسَنَا وَمَنْ سَيَّات أعْمَالِنَا مَنْ يهده اللهُ فَلا مُضِلَّ لَهُ وَمَنْ يُضْلِلهُ فَلَا هَادِيَ لَهُ ، وَنَشْهَدُ أَنْ لَا اله الا اللهُ وَحْدَهُ لا شَريكَ لَهُ. وَنَشْهَدُ أَنَّ سَيْدَنَا وَمَولانَا مُحَمَّدًا عَبْدَهُ وَرَسُولُهُ صَلَّى اللهُ تَعَالَى عَلَيْهِ وَعَلى آله وصحبه وَبَارَكَ وَسَلَّمَ . أما بعد فاعوذ بالله من الشيطان الرجيم بسم الله الرَّحْمَنِ الرَّحِيم
وإِن كُنتُمْ فِي رَيْبٍ مِمَّا نَزَّلْنَا عَلَى عَبْدِنَا فَأْتُوا بِسُورَةٍ مِّن مثله وَادْعُوا شُهَدانَكُمْ مِنْ دُونِ اللَّهِ إِنْ كُنْتُمْ صَدِقِينَ – فَإِنْ لَمْ تَفْعَلُوا ولَنْ تَفْعَلُوا فَاتَّقُوا النَّارَ الَّتي وَقُودُهَا النَّاسُ والحِجَارَةُ أُعدت للكفرين . وَبَشِّرِ الَّذينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّلحَت أَن لَهُمْ جَنَّتِ تجرى من تَحْتِهَا الأَنْهَرُ كُلَّمَا رُزقُوا مِنْهَا مِنْ ثَمَرَةٍ رِزْقًا قَالُوا هذا الذي رُزِقْنَا مِنْ قَبْلُ وَأتُوا به مُتَشَابِهَا وَلَهُمْ فِيهَا أَزْواج مُطهَّرَةٌ وَهُمْ فِيهَا خَالِدُونَ
بارك الله لنا ولَكُمْ فِي القُرآن العظيم وَنَفَعَنَا وَإِيَّاكُمْ بالايات والذكر الحكيم
আল–কুরআনের মুজিজা
সম্মানিত হাজিরিন,
সূরায়ে বাক্বারার ২৩ নং আয়াত থেকে আলোচনা শুরু:
আজ সূরায়ে বাক্বারার ২৩ নং আয়াত তিলাওয়াত করা হয়েছে। ২১ এবং ২২ নং আয়াতে আল্লাহ তা’আলা একত্ববাদের বিবরণ দিয়েছেন, আর ২৩ নং ২৪ নং আয়াতে রাসূলের যথার্থ যোগ্যতার বিবরণ এসেছে । রাসূলের রাসূল হওয়ার প্রমাণ । হযরত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাসূল হওয়ার জন্য যত প্রমাণ আছে, এর মাঝে সবচেয়ে বড় প্রমাণ হল, পবিত্র কুরআন।
কুরআন কীভাবে রাসূলের সত্যতার সবচেয়ে বড় প্রমাণ?
এই প্রশ্নের জবাব হল ২৩ নং আয়াত । কুরআনের বহু মু’জিজা কুরআনেই বিদ্যমান। এর মাঝে একটি সাধারণ মু’জিযা হল, কেউ যদি কুরআনের কোনো সূরা বা কোনো আয়াত তিলাওয়াত করে, তাহলে তা প্রতিদিন মজা লাগে। আগের দিন তিলাওয়াতে যে মজা লাগে, পরের দিন তিলাওয়াতেও সে মজাই লাগে ৷
কেউ যদি কুরআনের কোনো সূরার বা কোনো আয়াতের তিলাওয়াত শুনে, আগের দিন শুনলে যে মজা লাগে, পরের দিন শুনলে সেই মজাই লাগে। তারপরের দিন শুনলে সেই মজাই লাগে । এর মজা ঠিক থাকে । এটা কুরআনের একটি বিশেষ মু’জিযা। একমাত্র কুরআন ছাড়া আর যত কিতাব দুনিয়াতে আছে, যত বই-পুস্তক দুনিয়াতে আছে, এর যে কোনো একটি অংশ কেউ যদি একবার পড়ে, মজা লাগলে আরেকবার পড়ে, তারপর আরেকবার পড়ে, এরপর আর পড়ে না ।
কিন্তু কুরআনের এতো বড় জ্বলন্ত মু’জিযা যে, কুরআনের কোনো আয়াত যদি প্রত্যেক দিন পড়ে, প্রথম পড়ায় যে মজা লাগবে পরের দিন পড়লে সেই মজা লাগবে। কুরআনের আয়াত প্রথম দিন শুনলে যেই মজা লাগে, পরের দিন শুনলে সেই মজাই লাগে। এই জন্য কুরআন যার যার সাধ্যমত সুন্দর করে তিলাওয়াত করতে হয় ।
এক হাদীসে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফরমান :
ليْسَ مِنَّا مَنْ لَمْ يَتَغَنَّ بالقرآن .
এই হাদীসের প্রধান ব্যাখ্যা হল, “যে ব্যক্তি কুরআনকে যথেষ্ট মনে করে না” সেই ব্যক্তি আমার উম্মত নয় । আপনারা কি মনে করেন? আমাদের যত সমস্যা আছে, সব সমস্যার সমাধানে কুরআন যথেষ্ট নয় কি?যারা কুরআনকে যথেষ্ট মনে করে না, আল্লাহর রাসূল বলেন, তারা আমার উম্মত নয় । এই হাদীসের অনেক ব্যাখ্যা আছে। এর মাঝে একটি ব্যাখ্যা এটা যে, যাকে আল্লাহ যেই পরিমাণ সুর দিয়েছেন, সেই পরিমাণ সুর দিয়ে যে ব্যক্তি কুরআনকে সুন্দর করে তিলাওয়াত করে না, সে ব্যক্তি আমার উম্মত নয় ।
তা হলে এই হাদীসের দ্বিতীয় ব্যাখ্যা মতে প্রত্যেকের-ই উচিৎ কুরআন তিলাওয়াত করার সময় যাকে আল্লাহ যে পরিমাণ সুন্দর সুর দিয়েছেন, সেই পরিমাণ সন্দর সুর দিয়ে কুরআন তিলাওয়াত করতে হবে। অবশ্যই এ ক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখতে হবে, আল্লাহ আমাকে যেই রকম সুর দিয়েছেন, আমি সেই রকমের সুরে পড়ব। আর একজনের সুর আমি নকল করতে যাব কেন?
নিজ সুরে কুরআন তিলাওয়াত করাই উত্তম:
অপরের সুর নকল করে পড়ার নির্দেশ হাদীসে নেই। যাকে আল্লাহ যেই পরিমাণ সুন্দর সুর দিয়েছেন, সেই পরিমাণ সুন্দর সুর দিয়ে পাঠ করবে। এরই মাধ্যমে কুরআনের মু’জিযা প্রকাশ পাবে । একই আয়াত বার বার তিলাওয়াত করলেও মজা কমবে না, একই আয়াতের তিলাওয়াত বার বার শুনলেও মজা কমবে না । যদি এই কুরআন আল্লাহর সত্য কালাম না হতো, তা হলে এমনটি হতো না । আর যখন প্রমাণ হয়ে গেল, কুরআন আল্লাহর সত্য কালাম, তা হলে নাযিল হল কার উপর?
পবিত্র কুরআন নাযিল হল কার উপর?
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উপর । সুতরাং কুরআনের সত্যতার দ্বারা নবীর সত্যতার প্রমাণ হয় । এইভাবে আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন এই কুরআনের মাধ্যমে বহু প্রমানাদি দ্বারা রাসূলের সত্যতা প্রমাণ করেছেন। এর মাঝে একটি প্রমান হল, সূরায়ে বাক্বারার ২৩ নং আয়াত । এখানে আল্লাহ বলেন-
وَإِنْ كُنْتُمْ فِي رَيْبٍ مِمَّا نَزَّلْنَا عَلَى عَبْدِنَا فَأْتُوا بِسُورَةٍ مِّنْ مِثْلِهِ وَادْعُوا شُهَدَائِكُمْ منَ دُون الله ان كُنْتُمْ صَدقِيْنَ .
তোমরা যদি সন্দেহ কর, এই কুরআন সত্যি সত্যিই আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত কি না—” তোমাদের যদি সন্দেহ হয়, এই কুরআন আল্লাহর কালাম নয়, এই কুরআন মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মনগড়া বানিয়ে বলে । এই কুরআন সত্য কালাম নয়। মুহাম্মদ মনগড়া বানিয়ে আল্লাহর কালামের নামে চালিয়ে দেয়। সে প্রেক্ষিতে আল্লাহপাক রাব্বুল আলামীন তাদের চ্যালেঞ্জ দিলেন এই বলে- وَإِنْ كُنْتُمْ فِي رَيْبٍ مِمَّا نَزَّلْنَا عَلَى عَبْدِنَا “যদি তোমাদের সন্দেহ হয়ে থাকে, তা হলে এক কাজ কর তোমরা। তোমরা যখন লেখা-পড়া করে সাহিত্যিক হয়েছ, পণ্ডিত হয়েছ, তোমরা সবাই সম্মিলিতভাবে এই কুরআনের যত সূরা আছে, এর মাঝে সবচেয়ে ছোট সূরা হচ্ছে ‘সূরাতুল কাউসার’ ।
সূরাতুল কাউসারের মতো একটি ছোট সূরা বানিয়ে দেখাও ৷
যে নবী জীবনে কোনো উস্তাদের কাছে লেখা-পড়া করেন নি, তিনি যদি মনগড়াভাবে এই কালাম বানাতে পারেন, তোমরা তো লেখা পড়া করেছ, অতি যুক্তিসংগতভাবে আরও সুন্দর করে বানানোর কথা। এই কথাটা সহজে বুঝার জন্য একটি কথা স্মরণ রাখতে হবে। যে যুগে হযরত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরব দেশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, এই যুগের বিশেষত মক্কার কুরাইশ বংশের লোকেরা যুগোপযুগী জ্ঞান-বিজ্ঞান ছাড়া অন্যান্য শিক্ষায় খুবই পারদর্শী ছিল; শুধু একটি বিদ্যায় তারা তৎকালীন যুগে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শিক্ষিত ছিল । বিজ্ঞানে তাদের শিক্ষা ছিল না ।
কিন্তু একটি শিক্ষায় তারা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শিক্ষিত ছিল। সেই সাবজেক্ট ছিল, সাহিত্য জ্ঞান । বিশুদ্ধভাবে কথা বলা তারা শিশুকাল থেকেই শিখে নিত। অতি উত্তম বর্ণনা ভঙ্গিতে কথা বলা, আকর্ষণীয় পদ্ধতিতে কথার পর্যালোচনা তাদের জাতিগত শিক্ষা ছিল। সুতরাং সাহিত্যে তারা সারা দুনিয়ার মাঝে বেশী অগ্রগামী ছিল ।
আল্লাহপাক রাব্বুল আলামীন বলেন “মুহাম্মদ সা. জীবনে কোনো দিন কোনো শিক্ষকের কাছে কথার বর্ণনা ভঙ্গি শিক্ষা গ্রহণ করেন নি” । তিনি যদি এমন সুন্দর কথা বলতে পারেন, তা হলে তোমরা যারা পৃথিবীর সেরা সাহিত্যিক, সারা পৃথিবীর বিখ্যাত কবি তোমাদের এর চেয়ে আরও বেশি সুন্দর মনগড়া কালাম বানানোর কথা।
বেশি সুন্দরের প্রয়োজন নেই, এই রকম সহীহ-শুদ্ধ সাহিত্য সম্পন্ন একটি সূরা, তাও বড় সূরা বানানো দরকার নেই। কুরআনের ১১৪ সূরার সবচেয়ে ছোট্ট সূরার নাম ‘সূরাতুল কাউসার’। সূরাতুল কাউসারের মতো ছোট-খাটো একটি সূরা বানিয়ে দেখাও । তখন বলতে পারবে যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে ধরনের কথা বলে, সেই ধরনের কথা আমরাও বলি । সুতরাং এগুলো আল্লাহর নাযিল করা কালাম, বিশ্বাস করা যায় না । এটা তার মনগড়া বানানো কথা ।
যদি কুরআন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উপর নাযিলকৃত নয় বিশ্বাস কর, তা হলে এর নজীর বা দৃষ্টান্ত পেশ কর। ঐ সমাজে নিয়ম ছিল কেউ যদি কারো সম্পর্কে চ্যালেঞ্জ করত, তাহলে চ্যালেঞ্জনামা কাগজে লিখে কাবা ঘরের দেয়ালে লটকিয়ে দেওয়া হত। এটা ছিল সেই যুগের চ্যালেঞ্জ করার পদ্ধতি। আমাদের বর্তমান গ্রহণযোগ্য চ্যালেঞ্জের পদ্ধতি হল, সাংবাদিক সম্মেলন করে চ্যালেঞ্জের ঘোষণা দেবে, আর না হয় কোনো পত্র-পত্রিকায় চ্যালেঞ্জের ঘোষণা দেবে।
সেই যুগে এরকম সাংবাদিকও ছিল না, আর সেই যুগে আমাদের যুগের মতো সংবাদপত্রও ছিল না। ঐ যুগের চ্যালেঞ্জের নিয়ম অনুযায়ী হযরত রাসূলে কারীম সা.-এর পক্ষ থেকে তাদের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জঞ্জনামা লিখে লটকিয়ে দেওয়া হল কা’বা ঘরের দেয়ালে । বলা হল, কুরআনের সবচেয়ে ছোট্ট সূরা, সূরায়ে কাউসারের মতো একটি ছোট্ট সূরা বানিয়ে দাও। চ্যালেঞ্জে তাদেরকে আরো কিছু সুবিধে দেওয়া হল, তোমরা যদি দু’চারজনে মিলে বানাতে না পার, তা হলে এই দুনিয়াতে সাহিত্য জগতে যত পণ্ডিত আছে, তাদের সবাইকে তোমাদের সঙ্গী বানিয়ে তোমাদের সহযোগী বানিয়ে সবাই সম্মেলিতভাবে সূরায়ে কাউসারের মতো একটি ছোট্ট সূরা বানিয়ে তোমরা এই চ্যালেঞ্জের জবাব দাও।
সেই যুগে আরো একটি নিয়ম ছিল, কেউ যদি কারো বিরুদ্ধে কাবা ঘরের দেয়ালে চ্যালেঞ্জনামা লটকিয়ে চ্যালেঞ্জ করত, তা হলে যার বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ঘোষণা করা হল, সেই লোকটা যতদিন পর্যন্ত চ্যালেঞ্জের জবাব দিতে না পারত, ততদিন পর্যন্ত সমাজে মুখ দেখাতে পারত না। চ্যালেঞ্জের জবাব না দিতে পারলে সাব্যস্ত হত সে হেরে গেল । কে হারল? কে জিতল, সে কথা যদি প্রমাণ করতে হয়, তাহলে সেই চ্যালেঞ্জের জবাব কাবা ঘরের দেয়ালে লটকাতে হয়। এই ছিল তখনকার সময়ের অবস্থা।সেই চ্যালেঞ্জনামা যখন কা’বা ঘরের দেয়ালে লটকিয়ে দেওয়া হল, তখন তো তারা জবাব না দিতে পারলে সমাজে ওরা হেরে যাবে প্রমাণিত হবে ।
তাই তারা অবস্থার প্রেক্ষিতে বাধ্য হয়ে সমস্ত পণ্ডিতেরা সমেবেত হল । কা’বা ঘরের চ্যালেঞ্জ এর জবাবে মনগড়া সূরা বানিয়ে দেওয়ার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করল। তারা কা’বা ঘরের দেয়ালে লটকানো সূরায়ে কাউসার যখন দেখল, তখন তারা বিপাকে পড়ল। এটাকে গদ্য বলারও অবকাশ নেই, পদ্য বলারও অবকাশ নেই। কারণ, গদ্য যদি হয়ে থাকে, তখন প্রত্যেকটা আয়াতে ছন্দের মিল থাকার কথা নয়। কিন্তু সূরায়ে কাউসারের প্রত্যেকটা আয়াতের শেষে ছন্দ মিল আছে।
إِنَّا أَعْطَيْنَكَ الْكَوْثَرْ – فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ – أَنَّ شَانِئَكَ هُوَ الْأَبْتَر
ছন্দ মিল আছে কি?
প্রত্যেকটা আয়াতের শেষের অক্ষর ر , (রা) ওয়াকফের অবস্থায় প্রত্যেকটা আয়াতের শেষে : ر ساکن, হয় । কাজেই এটাকে গদ্য গণ্য করা যায় না ।
কিন্তু আরবি সাহিত্যের পদ্ধতি মতে কোনো পদ্য বানাতে গেলে প্রতি দু’টি লাইনে একটি পঙক্তি হয়। যতক্ষণ পর্যন্ত দু’লাইন মিলিয়ে পঙক্তি না বানাবে ততক্ষণ পর্যন্ত পদ্য গণ্য হয় না ।
এখানে সূরায়ে কাউসারের প্রথম ও দ্বিতীয় আয়াত মিলে যদি একটি পংক্তি ধরা হয়, তা হলে তৃতীয় আয়াতের সাথে চতুর্থ কোনো আয়াত নেই, তাই পংক্তি হল না ।
সুতরাং এটা পদ্য হতে পারে না। তারা এমন বেকায়দায় পড়ল যে, এই সূরাকে পদ্য বলবে, না গদ্য বলবে, কোনটাই বলতে সুবিধা করতে পারলো না। সাহিত্যের পরিভাষায় কেউ যদি তার মনগড়া বানায় বা রচনা করে,
তাহলে সেটা হয়ত পদ্য হবে না, হয় গদ্য হবে?
এখন দেখা যায়, সূরায়ে কাউসারকে না পদ্য গণ্য করার উপায় আছে, না গদ্য গণ্য করার উপায় আছে।
এমতাবস্থায়ও জবাব না দিলে যেহেতু তারা হারবে, এই জন্য সমস্ত পণ্ডিতের দল মাথা ঘামাতে লাগল, কিভাবে আরেকটা সূরা বানানো যায় । শত চেষ্টা করেও তারা একটি সূরা বানাতে পারল না । একটি আয়াত বানাল । আরেকটা আয়াত বানিয়ে সূরায়ে কাউসারের তৃতীয় আয়াতের সাথে দ্বিতীয় লাইন মিলিয়ে একটি পংক্তি তৈরি করল ।
সূরায়ে কাউসারের প্রথম দু’আয়াতকে একটি পংক্তি সাব্যস্ত করে তৃতীয় আয়াতের সাথে চতুর্থ একটি আয়াত বানিয়ে এই আল্লাহর দেয়া তৃতীয় আয়াত আর তাদের মনগড়া বানানো চতুর্থ আয়াত মিলিয়ে একটি পংক্তি বানিয়ে এটাকে পদ্য আকারে কাবা ঘরের দেয়ালে লটকিয়ে বাড়ীতে চলে গেল ।
তারা যে মনগড়া আয়াতটি বানাল, সেই আয়াতটি হচ্ছে—
ليس هذا كلام البشر
এই সূরা কোনো মানুষের বানানো নয় ।
এটা তাদের বানানো আয়াতের তরজমা।
কথা বুঝে থাকলে বলুন তো তারা জিতল কি? হারল ।
তারাই আয়াত বানাল, আর এই অর্থ হল ‘এটা কোনো মানুষের বানানো নয়’। এমন চরমভাবে তারা হারল । আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন যখন চ্যালেঞ্জ করেছিলেন, তখন বলে দিয়েছিলেন-
فان لم تَفْعَلُوا وَلَنْ تَفْعَلُوا فَاتَّقُوا النَّارَ الَّتِي وَقُودُهَا النَّاسُ والحجَارَةُ أُعِدَّتْ لِلْكَفِرِينَ .
“যদি এই কালামের মতো কালাম বানাতে না পার আর পারবে তো না-ই। ‘যদি না পারো’ বলে সাথে সাথে ‘পারবে তো না-ই’ – এ কথা বলে দিয়েছেন।”
فَاتَّقُوا النَّارَ الَّتي وَقُودُهَا النَّاسُ وَالْحِجَارَةُ
“তাহলে সেই জাহান্নামের আগুনকে ভয় কর, যেই জাহান্নামের আগুনের জ্বালানী হবে মানুষ আর পাথর।”
اُعِدَّتْ لَلْکٰفِرِیْنَ
“সেই জাহান্নামের আগুন তৈরি করা হয়েছে যারা পবিত্র কুরআন বিশ্বাস করে না তাদের শাস্তি দেওয়ার জন্য । যারা আল্লাহর বিধানে বিশ্বাসী নয় তাদেরকে শাস্তি দেওয়ার জন্য । এই কথা আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন চ্যালেঞ্জ এর সাথে সাথেই উল্লেখ করে দিয়েছিলেন।
এতোদসত্ত্বেও তারা সমস্ত পণ্ডিতের দল চ্যালেঞ্জের জবাব দিতে লিপ্ত হল । যখন শত চেষ্টা করে সূরাতুল কাউসারের মতো একটি সূরা বানাতে পারল না, একটি আয়াত যা বানাল, আয়াতের অর্থ দাড়ায় এটা মানুষের মনগড়া কোনো কালাম নয় । এই জন্য আল্লাহপাক তাদের এই শোচনীয় পরাজয়ের দিকে ইঙ্গিত করে সূরায়ে বাক্বারার প্রথমে বলেছিলেন, الم ; এই الم হল কুরআনের মু’জিযার শ্রেষ্ঠ ইঙ্গিত। الم হল মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা.-এর যথাযথ সত্যতার প্রমাণ ।
কিভাবে الم কুরআনের সত্যতার প্রমাণ হয়, কিভাবে الم মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সত্যতার প্রমাণ হয়, তার বিবরণ তাফসীরে বায়যাবী শরীফে লিখা আছে।
আরবি বর্ণমালা উচ্চারণগত দিক থেকে তিন প্রকার:
আরবি বর্ণমালায় যে ২৯টি অক্ষর আছে, এই অক্ষরগুলো উচ্চারণগত দিক দিয়ে তিন প্রকার। আরবি বর্ণমালার কিছু অক্ষর গলার ভেতর থেকে উচ্চারণ হয়, এগুলোকে حروف حلقوم, বলা হয়। আরেক ধরনের অক্ষর মুখের ভেতর থেকে উচ্চারণ হয়, এগুলোকে حروف جوفی, বলা হয় । আরেক প্রকারের অক্ষর ঠোঁটের থেকে উচ্চারণ হয়, এগুলোকে حروف شفوی, বলা হয় ।
حروف حلقی ، حروف جوفی ، حروف شفوی গলা থেকে উচ্চারিত অক্ষর, মুখ থেকে উচ্চারিত অক্ষর, ও ঠোঁট থেকে উচ্চারিত অক্ষর এই তিন প্রকারের আরবী বর্ণমালা ছাড়া চতুর্থ প্রকারের আর কোনো অক্ষর নেই ।
তাহলে আরবি বর্ণমালা উচ্চারণগত দিক থেকে কত প্রকার? তিন প্রকার ।
এর মাঝে গলার ভেতর থেকে উচ্চারিত অক্ষরগুলো থেকে আল্লাহ নিয়েছেন الف আলিফের মাঝে কোনো হরকাত থাকে না। আলিফের মাঝে যখন জের, জবর, পেশ দেওয়া হয়, তখন আর আলিফ থাকে না; হামযাহ্ হয়ে যায়। যারা সহীহভাবে তিলাওয়াত জানেন তারা নিশ্চয়ই এর খবর রাখেন ।
সোজা টান দিয়ে ‘আলিফ’ লিখা হয়। যতক্ষণ পর্যন্ত তার মাঝে জবর না লাগে, যতক্ষণ পর্যন্ত তার মাঝে জের না লাগে, যতক্ষণ পর্যন্ত তার মাঝে পেশ না লাগে, ততক্ষণ পর্যন্ত এটা ‘আলিফ’ থাকে ।
আর যদি এই তিনটির যে কোনো একটি লাগে, তখন এটা আর আলিফ থাকে না। সেটার নাম হয় ‘হামযাহ’। কাজেই আলিফ চিনব আমরা কোন সময়? যখন তার ডানের অক্ষরে জবর থাকে তখন আলিফ আলাদাভাবে চিনা যায় ।
যেমন- با বা আলিফ যবর বা। ب . ا = با বা যবর বা, বা আলিফ যবর বা ب – ا = با বা যবর বা বললে বা লম্বা হয় না, با = বা আলিফ যবর বা বললে লম্বা হয়। با বলে লম্বা করলে পরেই আ-বলে একটি উচ্চারণ হয়, এটা সরাসরি একেবারে গলা থেকে উচ্চারিত হয়। এই কারণে আলিফকে حروف حلقی, গণ্য করা হয়। গলা থেকে উচ্চারিত অক্ষরগুলো থেকে আল্লাহ নিয়েছেন আলিফ মুখের ভেতর থেকে উচ্চারিত অক্ষরগুলো থেকে আল্লাহ নিয়েছেন লাম । যেমন- قل = ক্বাফ লাম পেশ কুল, লাম সাকিন অবস্থায় জিব্বার আগা আর উপরের তালু থেকে উচ্চারিত হয় ।
আর ঠোঁটের থেকে উচ্চারিত অক্ষর থেকে আল্লাহ নিয়েছেন মীম । الف لام میم এই তিনটি অক্ষর নিয়ে আল্লাহ ইঙ্গিত করেছেন, এই তিন প্রকার অক্ষর দিয়ে তোমরা লেখা-পড়া করে পণ্ডিতী কর। এই তিন প্রকার অক্ষর পড়ে তোমরা সাহিত্যিক হয়েছ, কবি হয়েছে। অথচ আমার নবী কোনো উস্তাদের কাছে আলিফও শিখেন নি, লামও শিখেন নি, মীমও শিখেন নি । আমার নবী কোনো দিন দুনিয়ার কোনো উস্তাদের কাছে এ, حروف حلقی ، حروف جوفی ، حروف شفوی ও শিখেন নি ।
তাহলে যে নবী দুনিয়ার কোনো উস্তাদের কাছে এই তিন প্রকারের অক্ষর শিখেননি, তিনি যদি এত সুন্দর কালাম মনগড়া বানাতে পারেন, তা হলে তোমরা যারা এই তিন প্রকারের অক্ষর দ্বারা লেখা-পড়া করতে করতে কবি হয়েছো, সাহিত্যিক হয়েছে, পণ্ডিত হয়েছো, তোমরা পারবে না কেন বানাতে?তোমাদের বানাতে না পারা কি একথার জ্বলন্ত প্রমাণ নয় যে, এই কুরআন মুহাম্মাদের মনগড়া বানানো কথা নয়; এটা আল্লাহর নাযিল করা কালাম ।
الم – এর মাধ্যমে প্রমাণ হয়েছে এগুলো আল্লাহর নাযিল করা কালাম । আর যখন একথা প্রমাণ হল যে, এই কালাম মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বানানো নয়; আল্লাহর নাযিল করা কালাম, তাহলে এ কালাম মিথ্যা না সত্য? সত্য । এ কালামের কথাগুলো সত্য না মিথ্যা? অবশ্যই সত্য ।
এবার এই কালামের কথাগুলোর মাঝে একটি কথা বলে দিচ্ছি। এই কালামের ২৬ পারার সূরাতুল ফাতাহর শেষের রুকুতে আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন ফরমান-
مُحَمَّدُ رَّسُوْلُ اللّٰہ
‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ এই কালামে আছে কি? অবশ্যই আছে। তাহলে যখন প্রমাণ হল, এই কালাম মনগড়া বানানো কথা নয়, আল্লাহর নাযিল করা কালাম । সাথে সাথে প্রমাণ হল, এ কালাম সত্য । যখন প্রমাণ হল, এই কালাম সত্য, তাহলে এই কালামের ভেতর যত কথা আছে, সব কথা সত্য ।
এই কালামের ভিতরে ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ একটি কথা আছে কি? কাজেই মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর রাসূল । অতএব কালামের সত্যতার মাধ্যমে এ কথার প্রমাণ হয়ে গেল যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সত্যি সত্যিই আল্লাহর রাসূল । হুদায়বিয়ার সন্ধির সময়ে যখন উভয় পক্ষের সম্মতিতে সন্ধি সম্পন্ন হয়ে গেল । তখন শুধু লেখা আর দস্তখতের বাকী।এমতাবস্থায় উভয় পক্ষ সন্ধি লেখার জন্য কাগজ-কলম হযরত আলী রাযি.-এর হাতে দিলেন। হযরত আলী রাযি. শিরোনাম লিখলেন-
هَذا مَا صَالحَ بَيْنَ أَهْلِ مَكَّةَ وَبَيْنَ مُحَمَّدٍ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ
এ চুক্তি মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আর কুরাইশ বংশের নেতাদের মাঝে সম্পাদিত চুক্তিনামা। তারা বলল, কাগজে যদি লিখ, তাহলে আমরা দস্তখত করব না । ব্যাপার কী ?
ব্যাপার হচ্ছে, মুহাম্মদকে আমরা রাসূল মানি না, এই জন্যই তোমাদের সাথে আমাদের দ্বন্দ্ব । যদি মুহাম্মাদকে রাসূল মেনে নেই, তাহলে তো তোমরা আর আমরা এক হয়ে গেলাম । তোমরা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা. মান; আর আমরা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ মানি না- এই হল দ্বন্দ্বের মূল । এমতাবস্থায় মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ যে কাগজে লিখা হল, এটার মাঝে দস্তখত করা মানেই হল মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ মেনে নিলাম ।
এতো বড় জলন্ত পরাজয় আমরা বরণ করতে রাজি না ।
হযরত মুহাম্মদ সা. হযরত আলী রাযি.-কে বললেন : “হে আলী! ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ না লিখে ‘মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ‘ লিখে নাও । আবদুল্লাহ‘র পুত্র মুহাম্মদ আর কুরাইশ বংশের সর্দারদের মাঝে সম্পাদিত চুক্তিনামা লিখে নাও ৷ কারণ এই চুক্তিনামাটি ছিল ১০ বছর মেয়াদী। আল্লাহ তো আমাকে ১০ বছর মেয়াদী রাসূল বানান নি। আমি চিরকালের জন্য রাসূল ।
হযরত আলী রাযি. বললেন, রাসূলুল্লাহ শব্দটি কেটে দেওয়ার মতো দুঃসাহস আমার নেই । তখন রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, হে আলী! রাসূলুল্লাহ শব্দটি কেটে দিতে যদি তোমার সাহস না হয়, তা হলে চুক্তিনামাটা আমার হাতে দাও ।
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন হযরত আলী রাযি.-এর থেকে কাগজ কলম নিজের হাতে নিয়ে কেটে দিয়ে লিখলেন-
هذا مَا صَالحَ بَيْنَ أَبَا اهْلِ مَكَّةَ وبَيْنَ مُحَمد ابن عبد الله
আবদুল্লাহ ইবনে মুহাম্মাদ ও মক্কার কুরাইশ নেতাদের মাঝে সম্পাদিত চুক্তিনামা ।
এই লেখা তিনি কোথায় শিখেছিলেন ?
এই লেখার বর্ণগুলো কোনো উস্তাদের নিকট শিখেছিলেন?
এই লেখার বাক্য গঠন তিনি কোনো উস্তাদের নিকট শিখেছিলেন? জীবনে কোনো দিন কোনো উস্তাদের নিকট শিখেন নি ।
সুতরাং যে লোক কোনো দিন কোনো উস্তাদের নিকট আলিফ লিখতে শিখেননি, পড়তে শিখেননি, যে লোক কোনো দিন কোনো উস্তাদের কাছে লিখার নিয়ম-পদ্ধতি শিখল না, এই লোকটা যদি সত্য নবী না হত, তা হলে কেমন করে লিখলেন ।
هَذا مَا صَالَحَ بَيْنَ أَبَا اَهْلِ مَكَّةَ وبَيْنَ مُحَمَّد ابْن عَبْد الله
হযরত সুহাইল রাযি. এর বাঁধা:
যাই হোক চুক্তি সম্পাদন হল । দস্তখত হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে একজন বাঁধা দিয়ে বলল, (তিনি হচ্ছে হযরত সুহাইল রাযি.) “হে আল্লাহর রাসূল! আপনারা হুদায়বিয়ার সন্ধির মাঝে একটি চুক্তি দিয়েছেন মক্কার কোনো মুসলমান এই দশ বছর মদীনায় গিয়ে কোনো আশ্রয় পাবে না। এই চুক্তিনামা হওয়ার আগেই আমি মুসলমান হয়েছি, যে কারণে মক্কাবাসী আমাকে নির্যাতন করছে। কাজেই দস্তখত করার আগে আমাকে আপনাদের দলভূক্ত করে দস্তখত করেন।
তখন তার বাবা এখনও মুসলমান হননি। তিনি এসে বললেন, আমার ছেলেকে আপনাদের দলভূক্ত করলে আমরা চুক্তিতে দস্তখত করব না। সেই প্রেক্ষিতে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত সুহাইল রাযি.-কে দশ বছরের নির্যাতনের মুখে রেখেই চুক্তিতে সই করলেন ।
তখন রাসূলের সাথে প্রায় দশ হাজার সাহাবী ছিলেন। তাদের প্রত্যেকেরই মনে মনে ক্ষোভ ছিল যে, তাদের কাছে এত নতি স্বীকার করার দরকার কি?
যে চুক্তিতে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লিখতে দিল না, সেই চুক্তি করার দরকার কি?
এমন দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে যখন তারা হুদায়বিয়ার মাঠ থেকে মদীনার পথে রওয়ানা দিলেন, তখন মদীনায় ফিরার পথে আল্লাহ তা‘আলা আয়াত নাযিল করলেন, ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ‘ অর্থাৎ হে আমার নবীর সাহাবাগণ! দশ বছর মেয়াদী সন্ধিচুক্তিতে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ লিখতে না দেওয়ায় তোমাদের মনে দুঃখ লেগেছে ।
যেই কুরআন কিয়ামত পর্যন্ত থাকবে, সেই কুরআনের অংশ বানিয়ে দিলাম ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ‘। এই হল মুহাম্মাদ সা. নবী হওয়ার আরেক দলীল ।
এখন যখন প্রমান হল কুরআন আল্লাহর সত্য কালাম । তারা যখন স্বীকৃত দিল-
“কুরআন মানুষের বানানো কালাম নয়।”
কাজেই প্রমানিত হল, কুরআন আল্লাহর সত্য কালাম। এখন কুরআন যদি সত্য হয়, তা হলে কুরআনের কথা কি মিথ্যা হবে? না অবশ্যই সত্য ।
তাহলে কুরআনের যত কথা আছে, এর মাঝে একটি কথা হল ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ‘। সুতরাং তোমরা সরাসরি স্বীকার কর আর না কর, তোমাদের ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ‘ স্বীকার করা হয়ে গেছে। এই ভাবে আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন কুরআন শরীফ দ্বারা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা.-এর সত্যতার প্রমাণ দিয়েছেন।
মহানবীর সত্যতার প্রমাণ মুফাসসিরীনে কেরামের বর্ণনা:
মুফাসসিরীনে কেরাম কুরআন যে মহানবীর সত্যতার প্রমাণ হয়, সেগুলোর অনেক দীর্ঘ বর্ণনা দিয়েছেন। এর মাঝে আমি আপনাদেরকে এক দু‘টি বিবরণ শোনাচ্ছি।
একটি বিবরণ হল, জন্ম থেকে দীর্ঘ ৪০ বছর পর্যন্ত তিনি কারো কাছে একটি অক্ষরও শিখলেন না। হঠাৎ করে তিনি এত সুন্দর কালাম বলা শুরু করলেন। এর দ্বারা কি প্রমাণ হয়, এগুলো মনগড়া বানানো না আল্লাহ প্রদত্ত আল্লাহর আল্লাহর পক্ষ থেকে সত্য কালাম? অবশ্যই আল্লাহর সত্য কালাম । কালাম যদি সত্য হয়, তাহলে এই কালামে আছে ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ‘।
অতএব মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর সত্য রাসূল । এই হল একটি পদ্ধতি রাসূলের যথাযথ সত্যতার প্রমাণ করার।
মহানবীর সত্যতার আরেকটি প্রমাণ হল:
ওরা যদিও বাহ্যিকভাবে বলত যে, আমরা ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ মানি না, এই কুরআনকে আল্লাহর সত্য কালাম মানি না। কিন্তু মনে মনে বুঝতো যে এই কালাম সত্য, মুহাম্মাদ আল্লাহর সত্য রাসূল । এই বিষয়টি সহজে বুঝার জন্য আপনাদেরকে একটি ঘটনা শুনাই।
এই মর্মে একটি ঘটনা
আবূ জাহেল, আবূ সুফিয়ান আর আহমদ ইবনে শায়খ এই তিন জন লোক রাতে লুকিয়ে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা.-এর কুরআন তিলাওয়াত শুনতো । সারা রাত মন ভরে, প্রাণ ভরে, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কুরআন তিলাওয়াত শুনল। শেষ রাতে যখন বাড়ী রওয়ানা দিল এক সাথে তিন জনের দেখা হল। আবূ জেহেল আবূ সুফিয়ানকে বলে, ‘তুমি কোথায় গিয়েছিলে?” আবূ সুফিয়ান আবূ জেহেলকে বলে, ‘তুমি কোথায় গিয়েছিলে?’ একে অপরকে বলল, মুহাম্মদের কুরআন শোনার জন্য গিয়েছিলাম ।
একজন বলল, “তোমরা তো সমাজের নেতা। সমাজের সাধারণ জনতা যদি জানে তোমরা লুকিয়ে কুরআন শুন, তা হলে জনতাকে আর ফিরাতে পারবে না।” কথা তো ঠিকই বলেছে। তা হলে কি করতে হবে ? তখন নেতারেই সিদ্ধান্ত করলো, আজকে যা শুনার শুনেছি আর কেউ শুনতে যাব না ।
পরদিন আবূ জেহেল ভাবল, আজ তো আর কেউ যাবে না, আমি একাই যাব । এভাবে আবূ সুফিয়ানও ভাবল। ঠিক এমনি আহমদও তা-ই ভাবল । পরদিন তিনজনে আবারও দেখা হল । বলল, কি ব্যাপার? গতকাল কথা দিলে আর যাবে না, কেন গেলে? বলে, তুমি গেলে কোন কাজে? তো আবার সিদ্ধান্ত হল যে, এরপর আর কেউ যাবে না। বাড়ীতে গিয়ে সবাই ভাবল, কাল তো আর কেউ যাবে না, আমি একাই যাব ।
তৃতীয় দিন আবূ সুফিয়ান আবার গেল, আবূ জেহেল আবার গেল, আহমদ আবার গেল । তৃতীয় দিন আবার যখন দেখা হল; তখন বলল এভাবে আর না
এখন কসম করতে হবে ।
প্রত্যেকেই কসম করে বলবে, আর কোনো দিন লুকিয়ে মুহাম্মাদের কুরআন তিলাওয়াত শুনতে যাবে না । আবূ জেহেলও কসম খেল, আবূ সুফিয়ানও কসম খেল, আহমদও কসম খেয়ে বলল ।
এখন যখন কসম খেয়েছে তখন তো আর যেতে পারে না। তারা কসম খেলে প্রাণের বিনিময়ে হলেও তা রক্ষা করে । এই কসম ভঙ্গের কেউ সাহস করল না কিন্তু তাদের নিজেদের মাঝে গোপনে কিছু আলোচনা হল ।
গোপনে কিছু আলোচনা:
আবূ সুফিয়ান আহমদকে বুঝায়, আজ তিন দিন পর্যন্ত তিলাওয়াত তুমিও শুনলে আমিও শুনলাম । কি বুঝলে? আহমদ বলে, যদি সত্য কথা বলতে হয়, তা হলে বলব- এই কুরআন মুহাম্মদ মনগড়া বানায় নি, এটা আল্লাহর দেওয়া কালাম । আহমদ আবূ সুফিয়ানকে বলে, বল তো তুমি কি ভেবেছ? আবূ সুফিয়ান বলে, আমার মনে তা-ই হয়। এখন তো দু‘জনের কথা এক রকম হয়ে গেছে, চল তো যাই বড় নেতার কাছে সে, কি বলে? তখন তারা দু’জনে বড় নেতাকে জিজ্ঞেস করতে গেল ।
তারা যখন আবূ জেহেলকে বলল যে, তিন দিন পর্যন্ত ওয়াদা ভঙ্গ করে গিয়েছিলেন কুরআন শুনার জন্য, তো কি বুঝলেন? এটা কি মুহাম্মদের মনগড়া বানানো কালাম? আবু জাহেল বলে, আল্লাহর কসম এতো সুন্দর কালাম মুহাম্মদ এর মনগড়া হতে পারে না। নিঃসন্দেহে আল্লাহর নাযিল করা কালাম । (আল্লাহু আকবার কাবীরা।)
তখন ছোট নেতা বড় নেতাকে বলে এতো শক্ত ভাষায় স্বীকার করলেন, তা হলে সমাজে তার বিরোধীতা করেছেন কেন? বলল, দেখ! মক্কায় কুরাইশ বংশে মুহাম্মাদ জন্ম নিয়েছে, আর আমি আরেকটি গোত্রে জন্ম নিয়েছি। আমরা দু‘গোত্রে সব সময়ই দ্বন্দ্ব চলে আসছে। সবাই চায় কে কাকে নিচে ফেলতে পারে। তারা যদি হাজার হাজার টাকা খরচ করে, বেটাগিরি দেখায় তো আমরা লাখ লাখ টাকা খরচ করে বেটাগিরি দেখাই। আজ যদি তাদের গোত্রে মুহাম্মদ নবী হয়ে যায়, তো আমাদের গোত্রে তো এরকম নবী দেখাতে পারব না ।
এখন যদি স্বীকার করে নিই যে, সে নবী হয়েছে, তা হলে তো সারা জিন্দিগীর সুনাম পদদলিত হয়ে যাবে। এ কারণে স্বীকার করি না।
আবূ জেহেল এর কথার দ্বারা আপনারা কি বুঝলেন যে, কুরআনের সত্যতা তাদের কাছে স্পষ্ট হয়েছিল কি না? অবশ্যই হয়েছিল ।
কুরআনের সত্যতা যদি প্রমাণ হয়ে থাকে, তা হলে এই কুরআনের দ্বারা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর সত্যতা প্রমাণিত কি না? অবশ্যই প্রমাণিত ।
এই হল দ্বিতীয় পদ্ধতি, যার মাধ্যমে আল্লাহপাক রাব্বুল আলামীন কুরআনকে মু‘জিযা সাব্যস্ত করেছেন। এই কুরআন সত্য প্রমাণ করার মানেই হল, মুহাম্মদ সা.-এর সত্যতা প্রমাণ করা ।
তৃতীয় পদ্ধতি :
এই কুরআন যে যুগে নাযিল হয়েছিল এই যুগের লোকদের ব্যপারে কুরআনে কতোগুলো ভবিষ্যত বাণী ছিল। সেই ভবিষ্যত বাণীগুলো অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়ন হয়েছে।
যেমন মুহাম্মদ সা.-এর যুগে কুরআন নাযিলের যুগে রোম ও পারস্যদের যুদ্ধ সম্পর্কে কুরআন ভবিষ্যতবাণী করল, পরবর্তী দশ বছরে তা-ই দেখা গেল। এটা কি এ কথার প্রমাণ নয় যে, কুরআন সত্য? অবশ্যই সত্য। যদি কুরআন সত্য হয়, তা হলে এই সত্যতা দ্বারা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সত্যতার প্রমাণ হল কি না? অবশ্যই । এই হল তৃতীয় পদ্ধতি যার মাধ্যমে কুরআনের সত্যতার দ্বারা মুহাম্মাদের সত্যতার প্রমাণ হয়ে যায় ।
চতুর্থ পদ্ধতি :
এই কুরআনকে একজন ইহুদী চ্যালেঞ্জ করল । কুরআন নাযিলের সময়ে ইহুদীরা বলতে লাগল, আমরা মুসা নবীর উম্মত। আমরা মূসা নবীর অনুসারী। আমরা ইয়াকুব নবীর আওলাদ, ইয়াকুব নবীর খান্দান। আমরা কোনো দিন দোযখে যাব না। আমরা বেহেশতে না গেলে আর কে বেহেশতে যাবে? এ হল তাদের দাবি। তখন কুরআন বলে— যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাক যে, তোমরা মরলে পরে তোমরা বেহেশতে যাবে আর কেউ বেহেশতে যাবে না। “তা হলে তোমরা দু’আ কর যে, “হে আল্লাহ! আমাদেরকে মৃত্যু দাও” যদি তোমাদের সাহস হয়।” এবার সাথে সাথে কুরআন বলে-
وَلَنْ يَتَمَنَّوْهُ أَبَدًا بِمَا قَدَّمَتْ أَيْدِيهِمْ وَاللَّهُ عَلِيمٌ بِالظَّالِمِينَ
কুরআন বলে দিল, “ওরা দাবি করে ওরা বেহেশতী আর কেউ বেহেশতী নয়। এমতাবস্থায় বলা হল, তা হলে দু‘আ কর “হে আল্লাহ আমাদের মৃত্যু দাও ।
অতঃপর আল্লাহ বলেন, তারা কখনও মৃত্যু কামনা করবে না। কারণ মনে মনে জানে কুরআন সত্য।
তারা জানে মরলে জাহান্নামে যাবে। তাই তারা মৃত্যু কামনা করবে না।
বাহ্যিক ভাবে বলে আমরা বেহেশতী কিন্তু ওরা জানে, মরলে জাহান্নামে যাবে ।
এদের মনের কথা আমি কুরআনে বলে দিলাম। এই পদ্ধতিতে আল্লাহ প্রমাণ করলেন যে, কুরআন সত্য আর এই কুরআনে আল্লাহ পরিষ্কার ভাষায় বলে দিয়েছেন محمّدُ رَّسول اللہ মুহাম্মদ আল্লাহর রাসূল । সুতরাং কুরআনের স্বাক্ষীর দ্বারা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা.-এর সত্যতা প্রমাণ হয়ে গেল ।
পঞ্চম পদ্ধতি :
কুরআনে আল্লাহপাক রাব্বুল আলামীন এমন সব অতীতের ঘটনা বর্ণনা করেছেন যে, হযরত আদম আ. থেকে নিয়ে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম-এর জামানা পর্যন্ত এমন বহু ঘটনা, বিশেষ বিশেষ নবী-রাসূলের ঘটনা স্ববিস্তারে বর্ণনা করেছে, এত বিস্তারিত ঘটনা তখনকার দুনিয়ার মানুষ কখনও জানত না ।
এই সত্য-সত্য অতীতের বিস্তারিত ঘটনার দ্বারা প্রমাণ হয়ে গেল যে, এই কুরআন যদি আল্লাহর কালাম না হত, পেছনের যুগের ঘটনা বিস্তারিত ভাবে বলা হত না । সুতরাং এই ইতিহাস কুরআনে সঠিকভাবে বর্ণনা করার দ্বারা প্রমানিত হয়ে গেল, কুরআন সত্য ।
আর কুরআন স্বীকৃতি দিয়েছে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম আল্লাহর সত্য নবী এবং রাসূল। সুতরাং এই পদ্ধতিতেও প্রমাণ হয়ে গেল মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সত্য নবী ।
৬ষ্ঠ পদ্ধতি :
আল্লাহপাক রাব্বুল আলামীন নিজে ওয়াদা দিয়েছেন-
انَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَفَظُونَ
“এই কুরআন আমি নিজের দায়িত্বে নাযিল করেছি, কিয়ামত পর্যন্ত কোনো মানুষ এই কুরআনের মাঝে কোনো রদ-বদল করতে পারবে না।” কুরআন নাযিল হওয়ার পর থেকে বর্তমানে দেড় হাজার বছর চলছে। এই দেড় হাজার বছরের ভিতরে আমাদের সামনে যে কুরআন আছে এর মাঝে যত লিখা আছে তাই কি মুহাম্মাদ সা.-এর উপর নাযিল হয়েছে? তার প্রমাণ অনেক। এর একটি প্রমাণ আমি আপনাদের সামনে পেশ করছি।
নিউ ইয়র্কের তত্ত্ব বিজ্ঞানী ড. মরিচ বুকাইলী কুরআনের ভুল ধরার জন্য চেষ্ট করেছিল। সে কুরআন পড়া শুরু করল। সে চেষ্টা করতে করতে মিশরের জাদুঘরে হযরত উসমান গণী রাযি. এর হাতের লিখা এক খণ্ড কুরআন শরীফ সংরক্ষিত আছে, সে সংবাদ পেল ।
এই ড. মরিচ বুকাইলী যদি উসমান গণী রাযি.-এর হাতে লিখা কুরআন আর মুসলমানদের সামনে যে কুরআন আছে তাতে যদি এক নুকতা পরিমাণ গড়মিল হয়, তা হলে সারা বিশ্বে চ্যালেঞ্জ করে দেবে, তোমাদের কুরআনে ভুল আছে।
এই ষড়যন্ত্র করে ড. মরিচ বুকাইলী মিশরের জাদুঘরের সংরক্ষিত উসমান রাযি. হাতে লিখা কুরআনের সাথে মিলিয়ে দেখল যে, একটা আয়াতে বেশ-কম নেই। একটি শব্দে বেশ-কম নেই। একটি জের যবরে বেশ-কম নেই। একটি নুকতায় বেশ-কম নেই। যেমনটা হযরত উসমান রাযি. লিখেছিলেন, তেমনটা বর্তমান দুনিয়ায় আছে। তা হলে আল্লাহ যে ওয়াদা দিয়েছিলেন-
انَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَفَظُونَ
“এই কুরআন আমি আল্লাহ নিজ দায়িত্বে নাযিল করেছি এই কুরআনে কোনো রদবদল কিয়ামত পর্যন্ত কেউ ঘটাতে পারবে না, আমি নিজের দায়িত্বে হেফাযত করব।” সেই ওয়াদা যথার্থ পাওয়া গেল কি না? পাওয়া গেল ।
পক্ষান্তরে ইহুদীদের কাছে আল্লাহ তাওরাত কিতাব নাযিল করেছিলেন,তাতে তাদের ইচ্ছে মতো রদ-বদল করেছে। খ্রিষ্টানদের জন্য ঈসা নবীর মাধ্যমে ইঞ্জিল কিতাব আল্লাহ নাযিল করেছিলেন, তাতে তারা ইচ্ছে মতো রদবদল ঘটিয়েছে।
এভাবে যত ধর্মাবলম্বী আছে, তাদের ধর্মগ্রন্থগুলো সবই বিকৃত । কিন্তু একমাত্র কুরআন, নবীর যুগের কুরআন আর দেড় হাজার বছর পরের কুরআনে মিলালে কোনো অক্ষরে বা কোনো নুকতায় পরিবর্তন পাওয়া যায় না । কোনো যের যবর এ পরিবর্তন পাওয়া যায় না। এটা কি কুরআনের মু’জিযা নয়, এটা কি কুরআনের সত্যতার প্রমাণ নয়?
যদি প্রমাণ হয়ে থাকে, তা হলে এই কুরআনের বর্ণনায় কি প্রমাণ হয়নি যে, মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল?
সপ্তম পদ্ধতি :
ঐ কুরআন যতই তিলাওয়াত করা হয়, ততই মজা লাগে। প্রথম তিলাওয়াতে যে মজা, দ্বিতীয় তিলাওয়াতে বেশী মজা, তৃতীয় তিলাওয়াতে তার চেয়ে বেশী মজা । কুরআন যতই তিলাওয়াত করা হয়, ততই মজা লাগে- এই রকম দুনিয়াতে আর কোনো গ্রন্থ নেই যার কোনো একটি অংশ বারবার পড়লে বারবার মজা লাগে। সুতরাং এটা কুরআনের সত্যতার প্রমাণ ।
অষ্টম পদ্ধতি:
শুধু বারবার পড়লেই মজা লাগে তা নয়, বারবার শুনলেও মজা হয় ৷ একজন সহীহ-শুদ্ধ কুরআন পড়নেওয়ালা আল্লাহ তাকে যে পরিমাণ সুর দিয়েছেন সেই পরিমাণ সাধ্য মতো সুর দিয়ে সুন্দর করে যখন পড়বে, তখন শুনলে মজা লাগবে । যতবার পড়বে ততবারই মজা লাগবে। এটা কুরআন সত্যতার প্রমাণ । কাজেই কুরআন যখন সত্য প্রমাণিত হয়ে গেল, তখন কুরআন পরিস্কার ভাষায় ঘোষণা দিয়েছে মুহাম্মদ সা. আল্লাহর রাসূল ।
সুতরাং এভাবে বিভিন্ন পদ্ধতিতে কুরআনের দ্বারা প্রমাণ হয়েছে হযরত মুহাম্মদ সাঃ আল্লাহর রাসূল। এই জন্যে আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন সূরাতুল বাক্বারার ২৩ নং আয়াতে বলেন-
وإِنْ كُنْتُمْ فِي رَيْبٍ مِمَّا نَزَّلْنَا عَلَى عَبْدِنَا فَأْتُوا بِسُورَةٍ مِّنْ مثله
وَادْعُوا شُهَدَاتَكُمْ مِنْ دُونِ اللَّهِ إِنْ كُنْتُمْ صَدقِيْنَ .
তোমরা যদি সন্দিহান হও, এই কুরআনের সত্যতার প্রতি, আমি যে নবীর কাছে কালাম নাযিল করি, এতে যদি তোমাদের সন্দেহ হয়, তোমরা সকলে মিলিত হয়ে একটি সূরা পেশ কর, যদি তোমাদের দাবি সত্য হয়ে থাকে ।
فان لم تَفْعَلُوا وَلَنْ تَفْعَلُوا فَاتَّقُوا النَّارَ الَّتِي وَقُودُهَا النَّاسُ والحجَارَةُ أُعدت للكفرين .
আর যদি তোমরা না পার, আর পারবে তো না-ই, তা হলে সেই আগুনকে ভয় কর, যে আগুনকে তৈরি করা হয়েছে । আল্লাহর কালাম অস্বীকারকারীদেরকে জ্বালিয়ে চিরকাল শাস্তি দেওয়ার জন্য জাহান্নাম তৈরী করা হয়েছে।”
জাহান্নামের আগুন তিন হাজার বছরের উত্তপ্ত আগুন:
হাদীস শরীফে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফরমান, “জাহান্নামের আগুনকে এক হাজার বছর উত্তপ্ত করেছে। তারপরে লাল রং ধারণ করেছে। তারপরে আরও এক হাজার বছর উত্তপ্ত করা হয়েছে যার ফলে সাদা রং ধারণ করেছে। তারপরে আরও এক হাজার বছর উত্তপ্ত করা হয়েছে, যার ফলে আমাবস্যার রাতের মতো অন্ধকার কালো রং ধারণ করা হয়েছে।
আল্লাহপাক রাব্বুল আলামীন বলেন, যদি কুরআন মনগড়া কালাম বল, তা হলে একটি সূরা বানিয়ে প্রমাণ পেশ কর। যদি প্রামণ পেশ করতে না পার, তা হলে কুরআনের সত্যতা ও রাসূলের সত্যতা স্বীকার কর। আর সূরা যদি বানাতে না পার, আর মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা.-এর সত্যতা স্বীকারও না কর, এই যদি তোমাদের অবস্থা হয়, তা হলে ঐ জাহান্নামে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ কর।”
আল্লাহ অন্য আয়াতে বলেন-
فَذكِّرْ إِنْ نَفَعَتِ الذِّكْرَى سَيَذَّكَّرُ مَنْ يَخْشَى وَيَتَجَنَّبُهَا الْأَشْقَى الَّذِي يَصْلَى النَّارَ الكُبْرَى
“হে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম! আপনি ওয়াজ করতে থাকুন; নিশ্চয়ই ওয়াজে উপকার হবে। যারা আল্লাহর গজবকে ভয় পায় । কিন্তু জানে না কোন পথে আল্লাহর গজবে লিপ্ত হবে । এদের জন্য ওয়াজ উপকার হবে। আর যারা আল্লাহর গজবের ভয় পায় না, দুনিয়ার মোহে পড়ে দিল শক্ত হয়েছে, তাদের এই ওয়াজে উপকার হবে না। এদেরকে জাহান্নামের বড় আগুন দিয়ে শাস্তি দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হবে।”
কত বছরের উত্তপ্ত আগুন? তিন হাজার বছরের উত্তপ্ত আগুন । তিন হাজার বছরের উত্তপ্ত আগুন সহজে বুঝার জন্য একটি উদাহরণ দিচ্ছি। একটি লোহার টুকরা। এই লোহার টুকরাকে আগুনে ফেললে কত সময়ে লাল হয়? পাঁচ মিনিট । তাই তিন হাজার বছর উত্তপ্ত করলে কি রং ধারণ করবে সেটা অনুমান করুন।
তাই আল্লাহপাক বলেছেন, যারা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা.-এর সত্যতা বিশ্বাস করে না, যারা কুরআনের সত্যতা স্বীকার করে না, তাদেরকে সেই আগুন দিয়ে শাস্তি দেওয়া হবে, যেই আগুন তৈরি করা হয়েছে।
আল্লাহর বিধান যারা বিশ্বাস করে না, নবীর নবুওয়াত যারা বিশ্বাস করে না, রাসূলের রিসালত যারা বিশ্বাস করে না, তাদেরকে চিরকাল জ্বালিয়ে শাস্তি দেওয়ার জন্য । আল্লাহ আপনাদেরকে, আমাকে, সবাইকে কুরআনের সত্যতা বিশ্বাস করে, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম-এর সত্যতা বিশ্বাস করে কুরআনের সকল হুকুম ও রাসূলের বাতলানো তরিকা নিজেদের জীবনে বাস্তবায়ন করার তাওফীক দান করুন। আমীন ।
সারকথা: এই আলোচনা মূলত আল-কুরআনের অলৌকিকত্বের মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর নবুয়ত প্রমাণ করে। কুরআনের সৌন্দর্য, প্রভাব ও সাহিত্যিক শ্রেষ্ঠত্ব এতটাই অনন্য যে, তা মানবসৃষ্ট কোনো সাহিত্য দ্বারা অনুকরণ করা সম্ভব নয়। আল্লাহর এই চ্যালেঞ্জ আজও অক্ষত, আজও অপরাজেয়।
hi