ইতেকাফের ফজিলত ও গুরুত্ব, ইতেকাফের নিয়ম নিতী।
ইতেকাফের সংজ্ঞা:
‘ইতেকাফ’ আরবি শব্দ। এর অর্থ অবস্থান করা, নিজেকে কোনো স্থানে আবদ্ধ করে রাখা। আর শরিয়তের পরিভাষায় কতগুলো বিশেষ শর্তসাপেক্ষে একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে মসজিদে অবস্থান করাকে ইতেকাফ বলে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মানবজাতিকে একমাত্র তাঁর ইবাদত-বন্দেগির জন্য সৃষ্টি করেছেন। তিনি নিজেই ঘোষণা করেছেন, ‘আমি মানুষ এবং জিন জাতিকে একমাত্র আমার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি।
কাজেই মানবজাতির কর্তব্য হলো আল্লাহপাকের ইচ্ছাকে পূর্ণ করা– কাজকর্মে, আচার- ব্যবহারে, কথাবার্তায়, ব্যবসা-বাণিজ্যে, দিনে-রাতে অর্থাৎ সর্বক্ষণ সর্বাবস্থায় আল্লাহর রেজামন্দি হাসিল করা, তাঁর ইবাদতে মশগুল থাকা।
ফরজ ইবাদত ছাড়া আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য যেসব ইবাদত করা হয় তার মধ্যে ইতেকাফ একটি অন্যতম ইবাদত। আত্মার উৎকর্ষ সাধনের জন্য সব ধরনের কুপ্রবৃত্তি দমন করে যেমন– অনর্থক কাজ, অশ্লীল কথাবার্তা, সংসার, স্ত্রী-পুত্র, বাড়িঘর, ব্যবসা-বাণিজ্য তথা সব ধরনের দুনিয়াদারির কাজকর্ম পরিত্যাগ করে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভের জন্য তাঁর দরবারে দিনরাত্রি পড়ে থাকাই ইতেকাফের মূল লক্ষ্য।
ইতেকাফেরফজিলত
হজরত আম্মাজান আয়শা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রমজান মাসের শেষ ১০ দিন ইতেকাফ করবে সে দুটি ওমরাহ হজ্জ্ব ও দুটি বড় হজ্জ্ব আদায় করার সওয়াব পাবে। ’হজরত আয়েশা (রা.) আরো বলেন, ‘নবী করিম (সা.) রমজানের শেষ ১০ দিন ইতেকাফ পালন করতেন। তাঁর ওফাতের আগ পর্যন্ত তিনি ইতেকাফ পালন করে গেছেন। তারপর তাঁর পত্নীরাও তা পালন করেছেন।
হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, ইতেকাফকারী নিজেকে পাপ থেকে মুক্ত রাখে এবং তাঁর জন্য পুণ্যসমূহ জারি রাখা হয়। (মিশকাত) অন্য এক হাদিসে বর্ণিত আছে, যে ব্যক্তি একদিন ইতেকাফ করে আল্লাহপাক তাঁর এবং জাহান্নামের মধ্যে তিন খন্দক দূরত্বের ব্যবধান রাখবেন। এই দূরত্ব হবে আসমান ও জমিনের দূরত্বের চেয়েও অধিক।
ইতেকাফেরগুরুত্ব :
২০ রমজানুল মুবারক সূর্যাস্তের কিছুক্ষণ আগে থেকে ২৯ অথবা ৩০ রমজান সূর্যাস্ত পর্যন্ত অর্থাৎ ঈদুল ফিতরের চাঁদ দেখা পর্যন্ত পুরুষদের জন্য মসজিদে এবং নারীদের জন্য নিজ গৃহে নামাজের নির্ধারিত স্থানে নিয়মিত একাধারে অবস্থান করাকে ইতেকাফ বলে। রমজানের শেষ দশ দিনের এই ইতেকাফ সুন্নতে মুয়াক্কাদায়ে কেফায়া। অর্থাৎ কোনো বস্তি বা মহল্লার একজনকে হলেও এই ইতেকাফ অবশ্যই করতে হবে। যদি অন্তত কোনো এক ব্যক্তি এই ইতেকাফ করে নেন, তাহলে সারা মহল্লাবাসীর পক্ষ থেকে ইতেকাফ আদায় হবে; কিন্তু মহল্লাবাসীর মধ্যে থেকে কেউ যদি ইতেকাফ আদায় না করেন, তবে এই দায়িত্বের প্রতি অবহেলার কারণে মহল্লাবাসী সবাই গুনাহগার হবেন।
কাজেই সব মহল্লাবাসীর ওপর এই দায়িত্ব অর্পিত হয় যে, আগে থেকে তারা খোঁজখবর নিয়ে দেখবেন, তাদের এলাকার মসজিদে কেউ ইতেকাফ করবে কিনা। যদি এমন পাওয়া না যায়, তাহলে চিন্তাভবনা ও আলাপ-আলোচনা সাপেক্ষে ইতেকাফে বসাতে হবে। কিন্তু স্মরণ রাখতে হবে, উজরত অর্থাৎ বিনিময় বা পারিশ্রমিক দিয়ে কাউকে ইতেকাফে বসানো জায়েজ নয়। কেননা ইবাদতের উজরত দেওয়া ও নেওয়া উভয়ই শরিয়তের দৃষ্টিতে নাজায়েজ ও হারাম (শামী)।
ইতেকাফকারী যেন তার নিজ শরীর ও সমুদয় সময়কে আল্লাহর রাস্তায় ওয়াকফ করে দেন। ইতেকাফ অবস্থায় ইতেকাফকারী সার্বক্ষণিক নামাজের সওয়াব পেয়ে থাকেন। যেহেতু মসজিদ আল্লাহর ঘর, সেহেতু ইতেকাফকারী আল্লাহর প্রতিবেশী বা আল্লাহর ঘরের মেহমান হয়ে যান।
ইতেকাফের ফজিলত অনেক বেশি। রমজান মাসের শেষ ১০ দিন ইতেকাফ করলে ২৭ রমজান যদি শবে কদর না-ও হয়, তবু এ ১০ দিনের মধ্যে নির্দিষ্ট শবে কদরের ইবাদত ইতেকাফে আদায় হয়ে যায় এবং এর ফলে কদরের রাতের ফজিলতও লাভ করা যায়।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যারা অন্তত এক দিন এক রাত ইতেকাফ করবে, তাদেরও জাহান্নামের মাঝখানে এরূপ তিনটি খন্দক আড় হবে, যার প্রত্যেকটির প্রশস্ত হবে ৫০০ বছরের রাস্তা। ইতেকাফ অবস্থায় মানুষ আল্লাহর সম্মুখে এমনভাবে হাজির হয়ে থাকে যে, দুনিয়ার কোনো কিছুর প্রতিই তার খেয়াল থাকে না।
তিনি তখন মৃত ব্যক্তির মতোই নিজেকে আল্লাহর মর্জির ওপর সঁপে দেন। মানুষ যতক্ষণ ইতেকাফ অবস্থায় থাকে ততক্ষণ তার প্রতিটি মুহূর্ত ইবাদত হিসেবে লেখা হয়। তার ঘুম, খাওয়া-দাওয়া, প্রতিটি নড়াচড়া পর্যন্ত ইবাদতে গণ্য হয়। ইতেকাফে নবীয়ে করিম (সা.)-এর বিশেষ আকর্ষণ ছিল। তিনি প্রতি বছর রমজান মাসের ইতেকাফের প্রতি অত্যন্ত গুরুত্বারোপ করতেন। তিনি কখনো পুরো রমজান মাস ইতেকাফ করেছেন। ১০ দিনের ইতেকাফ তো তিনি প্রতি বছর অবশ্যই করতেন।
একবার নবীজি সাঃ বিশেষ কারণে রমজান শরিফে ইতেকাফ করতে পারেননি, তাই শাওয়াল মাসে ১০ দিন রোজা রেখে তিনি ইতেকাফ করেছেন (বুখারি শরিফ)। কিছু লোক মসজিদের জন্য খুঁটি হয়ে যান (অর্থাৎ এরা সর্বদাই মসজিদে অবস্থান করে)। ফেরেশতারা মসজিদে এরূপ মুমিনের সঙ্গী হয়ে যান। এরূপ লোকেরা যদি কখনো মসজিদে অনুপস্থিত থাকেন, তাহলে ফেরেশতারা তাঁদের অনুসন্ধান করেন, অসুস্থ হলে তাঁদের দেখতে যান এবং তাঁদের কোনো প্রয়োজন দেখা দিলে ফেরেশতারা তাঁদের সাহায্য করেন।
ইতেকাফের ফজিলত শুধু পুরুষদের জন্য খাস নয়। নারীরাও এই ফজিলতে শরিক হতে পারেন। কিন্তু নারীদের মসজিদে ইতেকাফ করা উচিত নয়। তারা ইতেকাফ নিজ গৃহে করতে পারেন। তারা ঘরের নামাজ ও ইবাদতের জন্য যে স্থানটি আলাদা করে রাখা আছে, সে জায়গায় ইতেকাফে বসে যাবেন। যদি আগে থেকে ঘরে এমন স্থান নির্দিষ্ট করা না থাকে তাহলে ইতেকাফের আগে ঘরে একটি স্থান নির্দিষ্ট করে নেবেন এবং সেখানেই ইতেকাফ করবেন। (শামী)
নারী বিবাহিত হলে ইতেকাফের জন্য স্বামীর অনুমতি নিতে হবে। স্বামীর অনুমতি ছাড়া তাদের জন্য ইতেকাফ করা জায়েজ নয়। (শামী) কিন্তু স্বামীর উচিত হলো স্ত্রীকে অনুমতি দেওয়া এবং বিনা কারণে তাদের ইতেকাফ থেকে বঞ্চিত না করা। নারীদের ইতেকাফের জন্য হায়েজ ও নেফাস থেকে মুক্ত থাকা জরুরি।
যদি কোনো নারী ইতেকাফ শুরু করেন, অতঃপর ইতেকাফ থাকা অবস্থায় হায়েজ শুরু হয়ে যায়, তাহলে হায়েজ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ইতেকাফ ছেড়ে দেওয়া তার ওপর ওয়াজিব। এমতাবস্থায় যেদিন ইতেকাফ ছাড়বেন, শুধু সেদিনের ইতেকাফ কাজা আদায় করা তার ওপর ওয়াজিব হবে। কাজা আদায় করার নিয়ম হলো হায়েজ থেকে পবিত্র হওয়ার পর যে কোনো দিন রোজা রেখে ইতেকাফ করবেন। যদি রমজান মাসের দিন বাকি থাকে তাহলে রমজানেও কাজা আদায় করতে পারবেন।
নারীরা ঘরের যে স্থান ইতেকাফের জন্য নির্দিষ্ট করবেন, সে স্থানটি ইতেকাফকালীন তার জন্য মসজিদের হুকুমের অন্তর্ভুক্ত হবে। ইসলামী শরিয়তের কোনো প্রয়োজন ছাড়া সেখান থেকে সরে যাওয়া জায়েজ হবে না। সে স্থানটির নির্দিষ্ট সীমার বাইরে, ঘরের অন্য অংশেও যেতে পারবেন না। নির্দিষ্ট সীমার বাইরে চলে গেলে ইতেকাফ ভঙ্গ হয়ে যাবে।
পুরুষের যেমন ইতেকাফ করতে চাইলে নিয়ত করতে হয়, রোজা রাখতে হয়, সুস্থ হতে হয়, কোনো নির্দিষ্ট মসজিদে অবস্থান করতে হয়, তেমনি নিজ গৃহে ইতেকাফকালীন নারীদের জন্যও এসব শর্ত সমানভাবে প্রযোজ্য।
এতেকাফেরশর্ত:
নিয়্যত করা, মুসলমান হওয়া, আকেল, বালেগ, হায়েজ নিফাস থেকে পবিত্র হওয়া, স্বামীর অনুমতি লওয়া, পুরুষের জন্য মসজিদ হওয়া।
এতেকাফের হুকুম:
ইতেকাফ শরীয়তের দ্রষ্টিতে সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ আলাল কিফায়াহ। অর্থাৎ সমাজের / মহল্লার কিছূ সংখ্যক লোক আদায় করলে সকলের পক্ষ থেকে দায়িত্ব আদায় হয়ে যাবে? কম-আজ কম একজন হলেও বসতে হবে। লোক ভাড়া করে বসানো যাবে না। কেউ যদি স্বতস্ফুর্তভাবে বসে তাহা ভিন্ন কথা । আল্লাহ্ তা’য়ালা আমাদেরকে সঠিক দ্বিন বুঝে আমল করার তৌফিক দান করুন। আমিন, সুম্মা আমিন।
FAQ
ইতিকাফের ফজিলত ও গুরুত্ব কী কী?
ইতিকাফের মাধ্যমে মুসলিমরা আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে পারেন এবং আত্মবিশ্লেষণের সুযোগ পান। ইতিকাফের গুরুত্ব খুব বেশি, বিশেষ করে রমজান মাসের শেষ দশ দিন, যখন মুসলিমরা ইতিকাফ করে আল্লাহর রহমত ও ক্ষমা লাভের জন্য বেশি চেষ্টা করে। এর মাধ্যমে একজন ব্যক্তি দুনিয়ার সম্পর্ক থেকে আলাদা হয়ে একমাত্র আল্লাহর দিকে মনোযোগ নিবদ্ধ করতে পারেন, যার মাধ্যমে তার ঈমান আরও মজবুত হয়।
ইতিকাফের গুরুত্ব কি?
ইতিকাফের মাধ্যমে মুসলিমরা একান্তে আল্লাহর কাছে মান্নত, দোয়া এবং তওবা করতে পারেন। এটি এক ধরনের আত্মশুদ্ধি, যা মুসলিমের বিশ্বাস এবং আমলকে পরিশুদ্ধ করে। এটি একটি মহান ইবাদত, যা মুসলিমকে তার দুনিয়া ও আখিরাতের শান্তি এবং সফলতা অর্জনে সাহায্য করে।
ইতিকাফের আরবি নিয়ত কী?
ইতিকাফের নিয়ত (নিয়ত ইতিকাফ) এর জন্য আরবিতে সাধারণত এই রকম বলা হয়:
“نَوَيْتُ الْاِعْتِكَافَ فَي الْمَسْجَدِ لِوَجْهِ اللهِ تَعَالٰى”
অর্থাৎ: “আমি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য মসজিদে ইতিকাফ করার নিয়ত করি।”
ইতিকাফ করা কি সুন্নত?
হ্যাঁ, ইতিকাফ করা সুন্নত। তবে এটি সুন্নতে মুয়াক্কাদা (অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত) এর মধ্যে পড়ে। বিশেষ করে রমজান মাসের শেষ দশ দিনে ইতিকাফ করা একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত, এবং যারা ইতিকাফ করতে সক্ষম, তাদের জন্য এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ইতিকাফ কত প্রকার ও কি কি?
ইতিকাফের দুইটি প্রধান প্রকার আছে:
ইতিকাফে ওয়াজিব: যদি কেউ কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যে বা কুরবানির জন্য বা ইতিকাফের ওয়াজিব নিয়ত করে, তবে এটি ওয়াজিব ইতিকাফ হয়। যেমন, মান্নাতের কারণে ইতিকাফ করলে তা ওয়াজিব হতে পারে।
সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ্ আলাল কিফায়াহ্ ইতিকাফ: এটি বিশেষত রমজান মাসে শেষ দশ দিনে করা হয়, যা সুন্নতে মুয়াক্কাদা হিসেবে পরিগণিত হয়।
সুন্নতে মুয়াক্কাদা কি?
সুন্নতে মুয়াক্কাদা হল সেই সুন্নত, যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং যার প্রতি মুসলমানদের শিথিলতা থাকা উচিত না। এটি এমন একটি সুন্নত ইবাদত, যা পালন না করলে তা হারাম বা গুনাহের মধ্যে পরিণত না হলেও, এর ছিন্নতা বড় ধরনের পাপ সৃষ্টি করতে পারে। যেমন, রমজান মাসের শেষ দশ দিন ইতিকাফ করা, যা সুন্নতে মুয়াক্কাদায়ে কিফায়াহ্।