ইসলামে রাজনীতির স্থান: দীন ও রাজনীতির সম্পর্ক
ভূমিকা:
ইসলামে রাজনীতির স্থান একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং গভীর আলোচনা। বর্তমান সমাজে যখন ধর্ম এবং রাজনীতি একে অপর থেকে পৃথক করে দেখতে চাওয়া হয়, তখন ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ ভিন্ন। ইসলামের শিক্ষা মানব সমাজের সর্বস্তরের জন্যে সমান এবং রাজনীতি তার অন্তর্ভুক্ত। খ্রিষ্টান বা সেক্যুলার দর্শন যেখানে ধর্মকে রাজনীতির থেকে আলাদা করতে চায়, ইসলামে তা একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। ইসলামে রাজনীতি শুধুমাত্র একটি শাখা নয়, বরং এটি দীন প্রতিষ্ঠার জন্য একটি উপায় ও মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত। এই প্রবন্ধে, আমরা ইসলামে রাজনীতির প্রকৃত অবস্থান এবং এর সাথে সম্পর্কিত ভ্রান্ত ধারণাগুলির প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করব।
ইসলামে রাজনীতির স্থান
সর্বপ্রথম বিষয় হলো ইসলামে রাজনীতির স্থানটি কোথায়? ইসলামে একটি সহীহ্ দল গঠনের গুরুত্ব কতখানি? খ্রিষ্টানদের এ ভণ্ড চিন্তাধারাটা খুব প্রসিদ্ধি লাভ করেছে, ‘কায়সারের অধিকার কায়সারকে দাও, গীর্জাকে দাও গীর্জার অধিকার’। যার সারমর্ম হলো এই— রাজনীতিতে ধর্মের কোন বালাই নেই। ধর্মের নিবাস ধর্মজগতে; রাজনীতির অবস্থান রাজনীতির ক্ষেত্রে। সবাইকে নিজ নিজ পরিমণ্ডলে থেকে কাজ করা চাই। একে অন্যের ছকে ঢুকে পড়া অবাঞ্ছিত। দীন ও রাজনীতির এ বিভক্তি-ভাবনাই পরবর্তীকালে সেক্যুলারিজম-এর রূপ পরিগ্রহণ করে- যা বর্তমান রাজনীতির দুনিয়ায় সমধিক সমাদৃত ।
বলার অপেক্ষা রাখে না, ইসলামে এ ধরনের ভাবনার কোন অবকাশ নেই। যেহেতু ইসলামের শিক্ষা মানব সমাজের সর্বস্তরের ও সর্বক্ষেত্রের জন্যে সমান, তাই রাজনীতিও তার অন্তর্ভুক্ত শামিল। ইসলামের দৃষ্টিতে রাজনীতিকে দীন থেকে সরিয়ে রাখার কোন অবকাশ নেই। এ জন্যেই, সমকালীন অনেক মুসলমানই খ্রিষ্টান ও সেক্যুলারিজমের এ দর্শনের জোর প্রতিবাদ করেছেন এবং প্রমাণ করেছেন যে, রাজনীতিকে দীন থেকে কখনো আলাদা করা যাবে না।
আল্লামা ইকবালের ভাষায় :
“দীন ছাড়া রাজনীতি বেশ;
চেঙ্গিস খানের মন্ত্র বটে’ ।
সেক্যুলারিজম কি ?
সেক্যুলারিজম (Secularism) এর বাংলা অর্থ হচ্ছে: ধর্মনিরপেক্ষতা।
সেক্যুলারিজম বলতে বোঝানো হয়— রাষ্ট্র বা সমাজ পরিচালনায় ধর্মকে সম্পূর্ণভাবে আলাদা রাখা, অর্থাৎ ধর্মীয় আদর্শ, আইন বা অনুশাসনের উপর নির্ভর না করে মানবিক বা ধর্ম-বিচ্ছিন্ন নীতিমালা দ্বারা পরিচালিত হওয়া।
হাল-জামানার বেশ কিছু ইসলামী চিন্তাবিদ-কলামিস্ট আলোচিত সেক্যুলারিজম অর্থাৎ ধর্ম থেকে রাজনীতিকে পৃথককরণ দর্শনের কঠোর বিরোধিতা করেছেন। আর এ বিরোধিতা করতে গিয়ে তারা শিকার হয়েছেন আরেকটি অতি সূক্ষ্ম ভুলের। যা বাহ্যত ক্ষুদ্র হলেও এর প্রতিক্রিয়া পরিব্যাপ্ত অনেক। ক্ষুদ্র ও সূক্ষ্ম এ ভুলটিকে আমরা সংক্ষেপে বলতে গেলে এভাবে বলতে পারি : ‘তারা সেক্যুলারিজমের বিরোধিতার আবেগে, রাজনীতিকে ইসলামীকরণের পরিবর্তে ইসলামকেই রাজনৈতিক বানিয়ে ফেলেছেন। বলার কথা ছিল, রাজনীতি ইসলামবিমুখ না হওয়া চাই । কিন্তু বলে ফেলেছেন ইসলাম রাজনীতিবিমুখ না হওয়া চাই’ ।
কথাটি আরেকটু ব্যাখ্যা করে বলছি
রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ইসলামের অনেক বিধি-বিধান আছে। অবশ্যই আছে। তাই ঈমানের দাবীও এটাই— প্রত্যেক মুসলমান সামর্থমাফিক অন্যান্য আকামের মতো এর উপরও আমল করবে এবং অন্যকে আমল করার কথা বলবে। শাসকের কর্তব্য হলো, ইসলামী আইন চালু করা, শরীয়ত অনুযায়ী সরকার প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট হওয়া। যদি হয়ে যায় তবে তার অনুসরণ করা। কিন্তু অধুনাকালের বেশ কিছু চিন্তাবিদ লেখক সেক্যুলারিজম বিরোধিতায় এতটা সরগরম ও উত্তেজিত হয়েছেন যে, তারা রাজনীতি ও হুকুমতকে ইসলামের অভীষ্ট লক্ষ্যে পরিণত করে দিয়েছেন। তারা বলেছেন, রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই ইসলামের মূল টার্গেট, নবীদের বুনিয়াদী লক্ষ্য; অভীষ্ট কামনা ও কাঙ্ক্ষিত মলি। বরং মানব সৃষ্টির লক্ষ্যই হলো, রাজনীতি ও হুকুমত প্রতিষ্ঠা। আর ইসলামের অন্যান্য আকাম, যেমন- ইবাদত ও অন্যান্য আমলকে তারা শুধু দ্বিতীয় স্থানে নামিয়েই ছাড়েননি বরং বলেছেন, রাজনীতি ও হুকুমত প্রতিষ্ঠার মাধ্যমমাত্র এগুলো। এগুলো হুকুমত প্রতিষ্ঠার একটি পথমাত্র ।
প্রান্তিকতা ও বাড়াবাড়িসঞ্জাত এ ভয়াল মানসিকতার কারণে সবচাইতে মারাত্মক যে ক্ষতিটি হয়েছে তাহলো, দীনের সামগ্রিক চিত্র ও ইসলামী বিধি-বিধানের যথার্থ অবস্থানটাই (Order of Priority) বদলে গেছে। যা য়-চিন্ত ছিল মাধ্যম বা উপায়- তাই মূল লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে সকলের হৃদয়- ায়। আর যা ছিল জীবনের মূল লক্ষ্য তা মাধ্যম ও উপকরণের দেশে গিয়ে ঠাঁই নিয়েছে। এবং এই চিন্তা-ভাবনার পরশে লালিত অনেকের মানসিকতাই আজ এইখানে এসে দাঁড়িয়েছে যে, একজন মুসলমানের জীবনের মূল লক্ষ্য রাজনীতি হওয়া চাই; রাষ্ট্র সংশোধনই হওয়া চাই একজন মুমিনের যিন্দেগীর মূল টার্গেট। তাদের ধারণা হলো, সেটাই মূল কাজ যা এপথে সাধিত হয়; এপথে নিবেদিত ত্যাগই সত্যিকারের ত্যাগ। পথিকৃত মনীষী তিনিই— এ পথে কেটেছে যার যিন্দেগানী। আর দীনের ইবাদত, ইতায়াত, তাকওয়া, যুহুদ, অন্যান্য শাখা; অন্যান্য হিস্সা যেমন- আত্মশুদ্ধি, আল্লাহর ভয় ও আল্লাহর সমীপে আত্মসমর্পণ ইত্যাকার সবকিছুই চরম অবহেলিত। বরং যারা এসব কাজে নিবেদিতপ্রাণ তাদের সম্পর্কে এ ধারণা পোষণ করা হয় এবং অন্যদের মাঝেও এ ভ্রান্তি ছড়িয়ে
দেয়া হয় যে, এরা মৌলিক বিষয়ে উদভ্রান্ত; মানব জীবনের মূল লক্ষ্য থেকে এরা অনেক দূরে।
দ্বিতীয় ক্ষতিটি হলো এই
যখন রাজনীতি আর হুকুমত প্রতিষ্ঠাই মানব জীবনের মূল লক্ষ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেল, এবং ইবাদতসহ অন্যান্য আকাম উপকরণের কোঠায় ঠাঁই নিল; তখন বলা বাহুল্য যে, কখনো কখনো মাকসুদ ও উদ্দেশ্য লাভের জন্যে, প্রয়োজনের খাতিরে উপকরণের গলায় ছুরি দিতে হয়। অনুরূপভাবে লক্ষ্য অর্জনের স্বার্থে মাধ্যম ও উপকরণগুলোতে প্রয়োজনে হেরফের করতে হয়। কমাতে-বাড়াতে হয় । আর লক্ষ্যকে অক্ষুণ্ণ রাখতে গিয়ে এসবই নীরবে সয়ে নিতে হয় । সুতরাং আলোচ্য প্রান্তিকতাবাদীদের বাড়াবাড়ির ফলে, জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে একথার বিরাট সুযোগ সৃষ্টি হলো যে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের স্বার্থে ইবাদত ও অন্যান্য আকাম পালনে যদি কোন দোষ-ত্রুটি হয়েও যায় তবুও সেটা দোষণীয় নয়। কেননা, এসব একটি বড় উদ্দেশ্য হাসিল করতে গিয়েই
হয়েছে।
রাজনীতিকে দীনের মূল লক্ষ্য ও অভীষ্ট টার্গেট ধারণা করা এতটা হাস্যস্পদ, ব্যবসা ও জীবিকা নির্বাহকে ইসলামের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বলা যতটা হাস্যস্পদ ও অবান্তর। যদি লক্ষ্য করা হয় দেখা যাবে, ইসলামের প্রচুর বিধি-বিধান ব্যবসার সাথে জড়িত। হালাল রিযিক উপার্জনের ফযীলত সম্পর্কে বিপুল সংখ্যক হাদীস রয়েছে। এখন যদি কেউ এসব ফযীলতের উপর ভিত্তি করে একথা বলতে থাকে, ইসলামের মূল টার্গেটই হলো ব্যবসা-বাণিজ্য । তাহলে একথাটি যে একান্ত মূর্খতাজনিত অবান্তর ও ভিত্তিহীন তা কোন দলীল প্রমাণ দিয়ে বুঝাতে হবে না ।
বলাবাহুল্য, ব্যবসার মতোই রাজনীতি ইসলামের সাথে সম্পৃক্ত একটি শাখা বিশেষ । কুরআন-হাদীসে যার ফযীলতের বেশ আলোচনাও রয়েছে। তবে সেসব ফযীলতের আঙ্গিকে রাজনীতিকে ইসলামের মূল লক্ষ্য বলা ব্যবসাকে ইসলামের মূল টার্গেট বানানোর মতোই অবান্তর-অসার ।
হিজরী চৌদ্দশ’ শতাব্দীর শুরুর দিকে- যখন থেকে এদেশের মুসলমানগণ পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের থাবা-আগ্রাসন রুখে দাঁড়ারার সংগ্রাম শুরু করলো, তখন থেকেই এই প্রান্তিকতাবাদী নীতি-দর্শন আরো ব্যাপক হতে লাগলো। তখন তারা রাজনীতিকে ‘খিলাফত-ফিল-আরদ’
যমীনের রাজত্ব ও ‘হুকুমতে-ইলাহিয়্যা’ আল্লাহর আইন ইত্যাকার চমকপ্রদ শ্লোগান ও শিরোনামের মাধ্যমে ইসলামের বুনিয়াদী বিষয়ে পরিণত করলো। ধীরে ধীরে এ ভ্রান্তচিন্তা মুসলমানদের মধ্যে নীরবে এতটা ছড়িয়ে পড়লো যে, বড় বড় চিন্তাবিদজনও টের করতে পারেনি কীভাবে তাদের মন-মানসিকতার মূল চাবিকাঠিই বদলে গেলো। স্বাধীন রাজনীতির গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা তাদের কাছে এতটা প্রকট ছিল, ইসলামের দৃষ্টিতে রাজনীতির প্রকৃত অবস্থানটা নির্ণয় করা এবং সুদূরপ্রসারী এ ভ্রান্তির সূক্ষ্ম কুফল নিয়ে ভাববার সুযোগই ছিল না তাঁদের হাতে। ফল এই দাঁড়ালো, কেউতো জ্ঞাতে, আবার কেউ অজ্ঞাতে এ ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করে বসলেন । আর আন্দোলনের সম্মিলিত কর্মব্যস্ততা বিষয়টি এতটা শক্ত করে দিল যে, অনেক বিদগ্ধ আলিমও নিজের চিন্তাধারার মূল চাবিকাঠির এ পরিবর্তন অনুমান করতে পারলেন না ।
আমার জানা মতে, পরিস্থিতির এ সংকটপূর্ণ অবস্থায় হাকীমুল উম্মত হযরত থানবী (রহ.)ই সর্বপ্রথম এ সূক্ষ্ম ভ্রান্তির জাল ছিন্ন করে, কুরআন- হাদীসের আলোকে ইসলামের দৃষ্টিতে রাজনীতির প্রকৃত অবস্থানটি চিহ্নিত করে দিয়েছেন। হযরত থানবী (রহ.) বলেন : আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন :
الذين إن مكنهم فى الأرض أقاموا الصلوة وأتوا الزكوة وأمروا بالمعروف ونهوا عن المنكر والله عاقبة الأمور.
“তাদেরকে যদি আমি পৃথিবীতে হুকুমত দান করি; তাহলে তারা যথাযথ নামায আদায় করবে, যাকাত দিবে, সৎকাজের প্রতি আদেশ ও মন্দকাজে বাধা দিবে । সকল কর্মের শেষ পরিণতি আল্লাহর হাতেই’।
এ আয়াত থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হচ্ছে, দিয়ানত বা দীনদারীই হলো ইসলামের মূল লক্ষ্য। রাজনীতি ও জিহাদ লক্ষ্য-বিষয় নয়। বরং দিয়ানত প্রতিষ্ঠার উপকরণ-উপায় ও মাধ্যম। এ কারণেই দিয়ানত ও তার আহকামতো সমস্ত নবী-রাসূলকেই দেয়া হয়েছে, তবে জিহাদ ও রাজনীতি সবাইকে দেয়া হয়নি। বরং যেখানে জিহাদের প্রয়োজন মনে করা হয়েছে, সেখানেই দেয়া হয়েছে; আর যেখানে প্রয়োজন অনুভূত হয়নি, সেখানে দেয়া হয়নি ৷ কেননা, মাধ্যম ও উপকরণের ব্যাপার এমনটিই হয়ে থাকে ।
কারো মনে আবার এ সন্দেহ জাগতে পারে, অন্য একটি আয়াতের বক্তব্যে তো এর বিপরীত বুঝে আসে। বুঝে আসে যেন রাজনীতি ও রাজ্যপ্রতিষ্ঠাকেই লক্ষ্য বলা হয়েছে; আর দিয়ানতকে তার উপকরণ প্রমাণ করা হয়েছে । আয়াতটি হলো :
وعد الله الذين آمنوا وعملوا الصالحت ليستخلفنهم في الأرض كما استخلف الذين من قبلهم وليمكنن لهم دينهم الذي ارتضى لهم.
‘তোমাদের মধ্য থেকে যারা ঈমান আনবে, নেক আমল করবে; আল্লাহ অঙ্গীকার করছেন, অবশ্যই তাদেরকে পৃথিবীতে খিলাফত-রাষ্ট্রীয়ক্ষমতা দান করবেন; যেভাবে তাদের পূর্ববর্তীদেরকে খিলাফত দান করেছেন। আরো প্রতিষ্ঠা দান করবেন সেই দীনের- যা তাদের জন্যে আল্লাহ মনোনীত করেছেন।
বক্ষমান আয়াতটিতে হুকুমত প্রতিষ্ঠার জন্যে ঈমান ও নেক আমলকে শর্ত বলা হয়েছে। এতেই প্রতীয়মান হয়, রাজনীতি ও হুকুমত প্রতিষ্ঠাই মূল লক্ষ্য। এর উত্তর অবশ্য সহজ। আসলে এ আয়াতটিতে ঈমান ও আমলে-সালেহ নেক আমলের প্রতিদানস্বরূপ হুকুমত ও শক্তি প্রতিষ্ঠার ওয়াদা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, দীনের বৈশিষ্ট্য হলো, যখন মুসলমানগণ পূর্ণ দীনের অনুসারী হবে, তখন ক্ষমতা তাদের পদচুম্বন করবে; শক্তিতে বলীয়ান হয়ে ওঠবে তারা। তাই বলবো, এখানে দীনের উপর আমল করার ভিত্তিতে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ওয়াদা করা হয়েছে। আর যে জিনিসের ওয়াদা- অঙ্গীকার করা হয়, ওটা লক্ষ্য হতে হয় এমনটি নয়। যেমন অন্য একটি আয়াতে ইরশাদ হয়েছে :
ولو أنهم أقاموا التوراة والانجيل وما أنزل إليهم من لأكلوا من فوقهم ومن تحت أرجلهم. ربهم –
‘যদি তারা তাওরাত, ইঞ্জিল ও তাদের প্রতি অবতীর্ণ কিতাব-কুরআনকে পুরোপুরি অনুসরণ করতো, তাহলে তারা উপর ও তলদেশ থেকে অবাধে রিযিক পেতো।’
এ আয়াতটিতে তাওরাত, ইঞ্জিল ও কুরআন যথাযথ আমল করার বিনিময়ে বিপুল-প্রসন্ন রিযিকের ওয়াদা করা হয়েছে। তাই বলে কি একথা বলা যাবে- দীনের মূল উদ্দেশ্য রিযিক? এবং এটা দীনদারীর বিনিময়ে প্রতিশ্রুত। এর অর্থ দীনদার কখনো ক্ষুধার্ত-বস্ত্রহীন থাকে না। প্রমাণিত হলো, অঙ্গীকৃত হলেই সেটা লক্ষ্য-বিষয় হতে হবে এমনটি জরুরি নয়। তদ্রুপ আমাদের আলোচ্য আয়াতেও ঈমান এবং আমলে- সালেহের বিনিময়ে ক্ষমতা, শক্তি ও হুকুমতের ওয়াদা করা হয়েছে। তাই এটাকে ঈমান ও নেক আমলের বৈশিষ্ট্যই বলতে হবে, লক্ষ্য নয়।
সারকথা হলো
রাজনীতি ও দীনদারী উভয়টার মধ্যে দীনদারীই মানব জীবনের মূল লক্ষ্য। তবে এর অর্থ আদৌ একথা নয়, রাজনীতি কোন অবস্থাতেই কাম্য নয়; বরং রাজনীতির অবস্থানটা হলো রাজনীতি মানব জীবনের মূল লক্ষ্য নয় । বরং দীনদারীই মানব জীবনের মূল লক্ষ্য। ( আশরাফুস-সাওয়ানেহ্- ৪র্থ খণ্ড, খাতিমায়ে সাওয়ানেহ্ ২৮, ২৯ পৃ. মুলতান থেকে প্রকাশিত ।)
বাস্তব হলো এই, হযরত হাকীমুল উম্মত (রহ.) এই কয়েক লাইনের সংক্ষিপ্ত কিন্তু সারগর্ভ আলোচনা দ্বারা বিষয়টিকে বিলকুল পরিষ্কার করে দিয়েছেন; আর তা একান্তই আল্লাহর তাওফীকে । হযরত থানবীর বক্তব্যের সারমর্ম হলো এই— রাজনীতির সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই একথাও সহীহ্ নয়— যা সেক্যুলারিজমের দর্শন। আবার একথাও ঠিক নয়, মানব জীবনের মূল লক্ষ্য হলো রাজনীতি ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা।
দীন ও ইসলামের আসল লক্ষ্য
মূলত দীন ও ইসলামের আসল লক্ষ্য হলো আল্লাহর সাথে বান্দার সম্পর্ক কায়েম করা। ইবাদাত ও অন্যান্য আমলের মাধ্যমে যার কিঞ্চিত বিকাশ ঘটে মাত্র। আর রাজনীতি ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাও এ লক্ষ্য হাসিলের একটি মাধ্যম ও উপায় হতে পারে। কিন্তু ওটা লক্ষ্য বিষয় নয় এবং দীন প্রতিষ্ঠা তথা ইকামতে দীনও এর উপর নির্ভরশীল নয়। বরং মানব জীবনের লক্ষ্য অর্জনের অনেকগুলো মাধ্যমের মধ্যে একটি রাজনীতিও। তাই যে রাজনীতি ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এ পথে সহযোগী হয় তা নিশ্চয়ই প্রশংসা পাবার দাবীদার । পক্ষান্তরে যে রাজনীতি মানব জীবনের এ লক্ষ্য হাসিলের পথে সহযোগিতার বদলে দীনী মূল লক্ষ্য বিষয়গুলোকে ভেঙ্গেচুরে ক্ষত- বিক্ষত করে, সে রাজনীতি নিশ্চয়ই ইসলামী রাজনীতি নয়। ইসলামী নামে নামকরণ করলেও তা ইসলামী হবে না আদৌ ।
উপসংহার:
ইসলামের দৃষ্টিতে, রাজনীতি কখনোই মানব জীবনের মূল লক্ষ্য নয়, বরং এটি দীন প্রতিষ্ঠার একটি উপায়। রাজনীতির অবস্থান দীন থেকে পৃথক নয়, তবে এটি কখনোই দীন প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য হতে পারে না। ইসলাম তার অনুসারীদেরকে ধর্মীয় আচার, ইবাদত, এবং আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে জীবন গঠনের পরামর্শ দেয়, আর রাজনীতি একটি মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা যায় যাতে দীন প্রতিষ্ঠা সহায়ক হয়। রাজনীতি যদি দীন প্রতিষ্ঠার পথে বাধা সৃষ্টি করে, তবে তা ইসলামী রাজনীতি হিসেবে গন্য হবে না। তাই, একজন মুসলমানের জীবনধারা, সমাজে প্রতিষ্ঠিত ইসলামিক মূল্যবোধ ও দীন অনুসরণের মাধ্যমে পূর্ণতা লাভ করবে।
এই প্রবন্ধ থেকে পাঠক যা শিখবেন:
- ইসলামে রাজনীতি ও দীন একে অপরের পরিপূরক — আলাদা কিছু নয়।
- ইসলাম সেক্যুলারিজমকে গ্রহণ করে না, বরং সেক্যুলার ভাবনার বিরুদ্ধেই ইসলামের অবস্থান।
- রাজনীতি ইসলামের একটি উপায় মাত্র, মূল লক্ষ্য নয় — মূল লক্ষ্য হলো আল্লাহর ইবাদত ও সম্পর্ক গড়ে তোলা।
- কিছু ইসলামপন্থী চিন্তাবিদের সূক্ষ্ম ভ্রান্তি চিহ্নিত করা হয়েছে, যারা রাজনীতিকে ইসলামের চূড়ান্ত লক্ষ্য বানিয়ে ফেলেছেন।
- ইবাদত, তাকওয়া, আত্মশুদ্ধি — ইসলামের মূল দিকগুলোকে অবহেলা করা হলে দীন বিকৃত হয়।
- রাজনীতি ও হুকুমত ইসলামকে সহায়তা করতে পারে, কিন্তু তা ইসলামের মৌলিক টার্গেট না — এটাও শিখবে।
- হাকীমুল উম্মত হযরত থানবী (রহ.) এর বক্তব্যের মাধ্যমে ইসলামে রাজনীতির সঠিক অবস্থান বোঝা যাবে।
- আল কুরআনের বিভিন্ন আয়াতের সঠিক ব্যাখ্যার মাধ্যমে রাজনীতির অবস্থান স্পষ্টভাবে বোঝা যাবে।
- ইসলামী রাজনীতি কী এবং কী নয় — সেই পার্থক্য পাঠক বুঝতে পারবে।
- রাজনীতি ইসলামের শাখা হলেও, এটিকে ইসলামের কেন্দ্রবিন্দু ভাবা অজ্ঞতা — এই শিক্ষাও তারা গ্রহণ করবে।
- আদর্শ মুসলমানের লক্ষ্য কী হওয়া উচিত, সেটা বুঝতে পারবে — অর্থাৎ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও আত্মিক পরিশুদ্ধি।
- রাজনীতির মাধ্যমে দীন প্রতিষ্ঠা সহায়ক হলে তা গ্রহণযোগ্য, তবে দীনকে বিকৃত করে রাজনীতি করলে তা ইসলামী নয়।
- উপায় ও উদ্দেশ্যের মধ্যে পার্থক্য করতে শিখবে, যা ইসলামী চিন্তাধারায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।