ঈদের নামাজের নিয়ম ও জরুরি মাসআলা/মাসায়েল
আল্লাহ তাআলা মুসলিমদের দুটি ঈদ দান করেছেন; ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা। মুসলিমদের ঈদ ও উৎসব অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠীর উৎসব থেকে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম এবং অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। আল্লাহর যিকির ও তাঁর বড়ত্বের ঘোষণার মাধ্যমে শুরু হয় মুসলিমদের ঈদ। ঈদের দিনে মুসলিমদের প্রথম ও প্রধান আমল হল ঈদের নামায। ঈদুল আযহার বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
আল্লাহ তাআলা মুসলিমদের জন্য দুটি বিশেষ আনন্দের দিন দান করেছেন: ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা। এই উৎসবগুলো অন্যান্য জাতি ও গোষ্ঠীর উৎসব থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। মুসলিমরা ঈদের দিন আল্লাহর স্মরণ ও তাঁর মহত্ত্বের ঘোষণা দিয়ে দিনটি শুরু করে। ঈদের দিনের প্রধান ইবাদত হলো ঈদের নামাজ। ঈদুল আযহা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন…
إِنّ أَوّلَ مَا نَبْدَأُ بِهِ فِي يَوْمِنَا هَذَا أَنْ نُصَلِّيَ، ثُمّ نَرْجِعَ، فَنَنْحَرَ…
আজকের দিনে আমরা সর্বপ্রথম ঈদের নামায আদায় করব। এরপর কুরবানী করব…। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৯৬৮
আজকের নিবন্ধে আমরা ঈদের দিনের প্রধান ইবাদত, ঈদের নামাজের কিছু জরুরি মাসআলা আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।
ঈদের নামায কাদের উপর ওয়াজিব
মাসআলা: যাদের উপর জুমার নামাজ ফরয, তাদের উপর ঈদের নামাজও ওয়াজিব। অর্থাৎ, প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন, এবং যারা জামাতে উপস্থিত হয়ে ঈদের নামাজ আদায়ের সামর্থ্য রাখে—সেসব মুসলিম পুরুষের জন্য ঈদের নামাজ পড়া বাধ্যতামূলক।
সূত্র: আল-মুহীতুল বুরহানী ২/৪৭৬; বাদায়েউস সানায়ে ১/৬১৭; শরহুল মুনইয়া, পৃষ্ঠা ৫৬৫।
মাসআলা: মহিলাদের উপর ঈদের নামাজ ওয়াজিব নয়। একইভাবে, এমন অসুস্থ পুরুষ, যিনি ঈদগাহে গিয়ে ঈদের নামাজ আদায়ের সামর্থ্য রাখেন না, তার উপরও ঈদের নামাজ ওয়াজিব নয়।
সূত্র: কিতাবুল আছল ১/৩২৩; মাবসূত, সারাখসী ২/৪০; আল-মুহীতুল বুরহানী ২/৪৮৫; বাদায়েউস সানায়ে ১/৬১৭।
মাসআলা: মুসাফির, অর্থাৎ যে ব্যক্তি ৪৮ মাইল বা ৭৮ কিলোমিটার দূরত্বে ভ্রমণের উদ্দেশ্যে নিজ এলাকা ত্যাগ করেছে, তার উপর ঈদের নামাজ ওয়াজিব নয়। তবে যদি সে ঈদের নামাজ আদায় করে, তাহলে তা সহীহ হবে এবং সে এর সওয়াবও পাবে।
সূত্র: আত-তাজরীদ, কুদুরী ২/৯৮১; বাদায়েউস সানায়ে ১/৬১৭; আয-যাখীরাতুল বুরহানিয়া ২/৩৯৬।
মাসআলা: যারা হজ্বের সফরে রয়েছেন, তাদের জন্য ঈদুল আযহার নামাজের বিধান নেই।
সূত্র: আয-যাখীরাতুল বুরহানিয়া ২/৩৯৪।
ঈদের নামাযের ওয়াক্ত
মাসআলা: ঈদের নামাজের ওয়াক্ত শুরু হয় সূর্য উদিত হয়ে নামাজের নিষিদ্ধ সময় শেষ হওয়ার পর থেকে এবং তা যায়ওয়াল তথা সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়ার আগ পর্যন্ত স্থায়ী থাকে। এই সময়ের মধ্যেই ঈদের নামাজ আদায় করতে হবে। যায়ওয়ালের পর ঈদের নামাজ সহীহ হবে না।
সূত্র: সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১১৩৫; আন-নুতাফ ফিল ফাতাওয়া, পৃষ্ঠা ৬৫; আল-মুহীতুল বুরহানী ২/৪৭৭; বাদায়েউস সানায়ে ১/৬১৯।
মাসআলা: ঈদুল আযহার নামাজ ওয়াক্ত শুরু হওয়ার পর দেরি না করে দ্রুত আদায় করা মুস্তাহাব, যাতে কুরবানির কাজ দ্রুত শুরু করা যায়। একইভাবে, ঈদুল ফিতরের নামাজও ওয়াক্ত শুরু হওয়ার পর যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি আদায় করা উত্তম।
সূত্র: মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক, বর্ণনা ৫৬৫১; আন-নুতাফ ফিল ফাতাওয়া, পৃষ্ঠা ৬৭; আল-বাহরুর রায়েক ২/১৬০; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/১৫০।
ঈদের নামাজের স্থান
মাসআলা: ঈদের নামাজ ঈদগাহে বা খোলা মাঠে পড়া সুন্নত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং খুলাফায়ে রাশেদীন সবাই ঈদের নামাজ ঈদগাহে আদায় করতেন। হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাযি.) বলেন-…
كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ يَخْرُجُ يَوْمَ الفِطْرِ وَالأَضْحَى إِلَى المُصَلّى.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার দিন (ঈদের নামাযের জন্য) ঈদগাহে যেতেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৯৬৫
হযরত আলী রা. বলেন-
الْخُرُوجُ إِلَى الْجَبّانِ فِي الْعِيدَيْنِ مِنَ السّنّةِ.
দুই ঈদে (ঈদের নামাযের জন্য) খোলা মাঠে যাওয়া সুন্নত। -আলমুজামুল আওসাত, তবারানী, হাদীস ৪০৪০
মাসআলা: যদি খোলা মাঠে ঈদের নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা থাকে, তবে বিনা ওজরে মসজিদে ঈদের জামাত করা উচিত নয়। তবে যদি কেউ জরুরত ছাড়া মসজিদে ঈদের নামাজ আদায় করে, তাহলেও নামাজ সহীহ হবে।
প্রসঙ্গত, বর্তমানে শহরগুলোতে ঈদগাহের সংখ্যা কম থাকায় অধিকাংশ মসজিদেই ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। জায়গার সংকুলান না হওয়া, বৃষ্টি হওয়া বা অন্য কোনো ওজরের কারণে মসজিদে ঈদের নামাজ পড়লে তা সুন্নতের খেলাফ হবে না। ওজরের কারণে মসজিদে ঈদের নামাজ আদায়ের বৈধতা হাদিস দ্বারা প্রমাণিত।
হযরত আবু হুরায়রা (রাযি.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-…
أَصَابَهُمْ مَطَرٌ فِي يَوْمِ عِيدٍ، فَصَلّى بِهِمُ النّبِيّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ صَلَاةَ الْعِيدِ فِي الْمَسْجِدِ.
কোনো এক ঈদের দিন বৃষ্টি তাঁদেরকে পেয়ে বসে। ফলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদের নিয়ে মসজিদে ঈদের নামায আদায় করেন। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১১৫৩
ঈদের নামাযে তায়াম্মুম
মাসআলা: যদি ঈদের নামাজে শরিক হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে কেউ দেখে যে তার ওযু নেই এবং ওযু করতে গেলে জামাত ছুটে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে, তাহলে সে তায়াম্মুম করে ঈদের নামাজ আদায় করতে পারবে।
হযরত আব্দুর রহমান ইবনুল কাসিম (রাহ.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-
يَتَيَمّمُ وَيُصَلِّي إِذَا خَافَ.
(ঈদের নামায) ছুটে যাওয়ার আশঙ্কা হলে তায়াম্মুম করে নামায পড়ে নেবে। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা, বর্ণনা ৫৮৬৯)
হযরত ইবরাহীম নাখায়ী রাহ. বলেন-
يَتَيَمّمُ لِلْعِيدَيْنِ وَالْجِنَازَةِ.
ঈদ ও জানাযার ক্ষেত্রে (ছুটে যাওয়ার আশঙ্কায়) তায়াম্মুম করা যাবে। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা, বর্ণনা ৫৮৬৮) -কিতাবুল আছল ১/৩২০; আলমুহীতুল বুরহানী ২/৫০২
তবে জুমা ও ওয়াক্তিয়া নামাযে জামাত ছুটে যাওয়ার আশঙ্কায় তায়াম্মুমের উক্ত বিধান প্রযোজ্য নয়।
ঈদের নামাযে আযান–ইকামত নেই
মাসআলা: ঈদের নামাজে আজান ও ইকামতের কোনো বিধান নেই।
হযরত জাবির (রাযি.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলে
صَلّيْتُ مَعَ رَسُولِ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ الْعِيدَيْنِ، غَيْرَ مَرّةٍ وَلَا مَرّتَيْنِ، بِغَيْرِ أَذَانٍ وَلَا إِقَامَةٍ.
আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে একাধিকবার ঈদের নামায পড়েছি এবং আযান-ইকামত ছাড়া পড়েছি। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৮৭৮
তবে কেউ অজ্ঞতাবশত ইকামত দিয়ে দিলে এর কারণে নামায মাকরূহ হবে না। -কিতাবুল আছল ১/৩১৯; আলহাবীল কুদসী ১/২৪২; শরহুল মুনইয়া, পৃ. ৫৬৭
নিয়ত মুখে উচ্চারণ করা
মাসআলা: ঈদ বা যে কোনো নামাজ, রোজা কিংবা অন্যান্য ইবাদতের ক্ষেত্রে অন্তরের সংকল্পই নিয়ত হিসেবে যথেষ্ট। মুখে উচ্চারণ করা জরুরি নয় এবং এর কোনো প্রয়োজনও নেই। তবে অন্তরের নিয়তের সাথে মুখে উচ্চারণ করাও নিষেধ নয়। কেউ যদি নিজের ইচ্ছার দৃঢ়তার জন্য মুখে নিয়ত উচ্চারণ করে, তাহলে তা দোষণীয় হবে না। মুখে নিয়ত উচ্চারণ করলে নিজের মাতৃভাষাতেই করবে; প্রচলিত আরবি নিয়তের অনুসরণ করার প্রয়োজন নেই।
সূত্র: উমদাতুল কারী ১/৩৩; শরহুল মুনইয়া, পৃষ্ঠা ২৫৪; আদ্-দুররুল মুখতার ১/৪১৫।
ঈদের নামাযের নিয়ম
ঈদের নামাজের নিয়ম:
ঈদের নামাজ দুই রাকআত। নামাজ শুরু করার আগে নিয়ত করে তাকবীরে তাহরীমা বলে নামাজ শুরু করতে হবে এবং তারপর ছানা পড়তে হবে। ছানা পড়ার পর ‘আল্লাহু আকবার’ ‘আল্লাহু আকবার’ ‘আল্লাহু আকবার’ বলে আরও তিনটি তাকবীর বলবে। প্রথম দুই তাকবীর বলার সময় উভয় হাত কানের লতি পর্যন্ত উঠিয়ে, হাত না বেঁধে ছেড়ে দিতে হবে। তৃতীয় তাকবীর বলার সময় কানের লতি পর্যন্ত হাত উঠিয়ে বেঁধে নিতে হবে। এরপর সূরা-কেরাত পড়ে রুকুতে যাবে।
দ্বিতীয় রাকআতে দাঁড়িয়ে সূরা-কেরাত পড়ার পর রুকুতে যাওয়ার পূর্বে আগের নিয়মে তিনটি তাকবীর বলবে। তবে দ্বিতীয় রাকআতে তৃতীয় তাকবীর বলার সময়ও হাত না বেঁধে ছেড়ে দিতে হবে। এরপর চতুর্থ তাকবীর বলে রুকু করবে। তারপর অন্যান্য নামাজের মতো যথারীতি নামাজ শেষ করবে।
সূত্র: কিতাবুল আছল ১/৩১৯; আল-হাবীল কুদসী ১/২৪৩।
ঈদের নামাযের কেরাত
মাসআলা: ঈদের নামাজে প্রথম রাকআতে সূরা আ‘লা এবং দ্বিতীয় রাকআতে সূরা গাশিয়াহ, অথবা প্রথম রাকআতে সূরা কফ এবং দ্বিতীয় রাকআতে সূরা কমার পড়া সুন্নত। হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদের নামাজে এ সূরাগুলো তিলাওয়াত করতেন। তবে অন্য কোনো সূরা পড়লেও নামাজ সহীহ হবে।
সূত্র: সহীহ মুসলিম, হাদিস ৮৭৮; সুনানে নাসায়ী, হাদিস ১৫৬৭; কিতাবুল আছল ১/৩২১; আল-মুহীতুল বুরহানী ২/৫০০।
মাসআলা : জুমার নামাযের ন্যায় ঈদের নামাযের কেরাতও উচ্চৈঃস্বরে পড়া ওয়াজিব। আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-
كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ يَجْهَرُ بِالْقِرَاءَةِ فِي الْعِيدَيْنِ وَفِي الِاسْتِسْقَاءِ.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদ ও ইস্তেসকার নামাযে কেরাত উচ্চৈঃস্বরে পড়তেন। (সুনানে দারাকুতনী, হাদীস ১৮০৩) -জামে সগীর, পৃ. ১১৪
তাই ইমাম সাহেব উভয় রাকাতেই কেরাত উচ্চৈঃস্বরে পড়বেন।
ঈদের দ্বিতীয় রাকাতের রুকুর তাকবীর
মাসআলা: ঈদের নামাজের দ্বিতীয় রাকআতে রুকুর তাকবীরও অন্যান্য নামাজের রুকুর তাকবীরের মতো সুন্নত।
ঈদের নামাযের অতিরিক্ত তাকবীর সংক্রান্ত মাসায়েল
তাকবীরের সংখ্যা
মাসআলা: অন্যান্য নামাজের তুলনায় ঈদের নামাজে অতিরিক্ত কিছু তাকবীর রয়েছে। এসব তাকবীরের সংখ্যা সম্পর্কে বিভিন্ন হাদিস ও আছারে ভিন্ন ভিন্ন বর্ণনা পাওয়া যায়।
কিছু বর্ণনায় দুই রাকআতে মোট বারোটি তাকবীর উল্লেখ করা হয়েছে, আবার কিছু বর্ণনায় ছয়টি তাকবীর আসছে। এ ছাড়া আরও কয়েকটি সংখ্যার কথাও কিছু হাদিসে পাওয়া যায়।
হাদিসে বর্ণিত এসব সংখ্যার সবকটিই সহীহ এবং আমলযোগ্য। যেমন, বারো তাকবীরের নিয়ম যেমন হাদিস দ্বারা প্রমাণিত, তেমনি ছয় তাকবীরের নিয়মও হাদিস ও আছার দ্বারা প্রমাণিত। একাধিক প্রসিদ্ধ সাহাবি এই পদ্ধতির উপর আমল করেছেন।
ইমাম আহমাদ (রাহ.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন
اخْتَلَفَ أَصْحَابُ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي التّكْبِيرِ وَكُلّهُ جَائِزٌ.
তাকবীরের সংখ্যার বিষয়ে সাহাবায়ে কেরামের মাঝে কিছু মতপার্থক্য ছিল। তবে, তাঁদের থেকে বর্ণিত সব সংখ্যাই বৈধ ও অনুসরণযোগ্য। – (আল-ফুরূ’, মাকদিসী ৩/২০১)
অতএব, আমাদের দেশে ফিকহে হানাফীর অনুসারে ঈদের নামাজে ছয় তাকবীর পড়ার প্রচলন রয়েছে। কিন্তু কিছু গায়রে মুকাল্লিদ ভাই একে সুন্নতের বিপরীত ও ভিত্তিহীন বলে অভিহিত করেন, যা মূলত হাদিস ও আসারের পর্যাপ্ত জ্ঞানের অভাবকেই প্রকাশ করে। এ বিষয়ে বিশদ দলিলভিত্তিক আলোচনা জানতে চাইলে মাসিক আল-কাউসার (অক্টোবর-নভেম্বর ২০০৫ সংখ্যা) অথবা মাকতাবাতুল আশরাফ কর্তৃক প্রকাশিত ‘সহীহ হাদীসের আলোকে তারাবীর রাকাত সংখ্যা ও ঈদের নামাজ’ পুস্তিকা অধ্যয়ন করা যেতে পারে।
মাসআলা ১: ঈদের অতিরিক্ত তাকবীরের সংখ্যা নিয়ে সন্দেহ হলে কম সংখ্যাকে ভিত্তি ধরে বাকি তাকবীর সম্পন্ন করবে। যেমন, যদি সন্দেহ হয় যে তিন তাকবীর হয়েছে নাকি দুই, তাহলে দুই ধরে নিয়ে বাকি একটি তাকবীর আদায় করবে।
মাসআলা ২: যদি ইমাম প্রথম রাকাতে অতিরিক্ত তাকবীর বলা ভুলে গিয়ে কেরাত শুরু করে দেয়, তবে কেরাত অবস্থায় স্মরণ হলে কেরাত ছেড়ে তাকবীরগুলো আদায় করবে এবং পুনরায় কেরাত পড়বে। কিন্তু কেরাত শেষ হওয়ার পর স্মরণ হলে, তখন তাকবীর আদায় করে সরাসরি রুকুতে চলে যাবে।
উৎস: আততাজরীদ, কুদুরী ২/৯৮৪; আলমুহীতুর রেযাবী ১/৪১৭; শরহুল মুনইয়া, পৃ. ৫৭২
মাসআলা ৩: যদি ইমাম ভুলবশত ঈদের অতিরিক্ত তাকবীর না বলে রুকুতে চলে যান (প্রথম বা দ্বিতীয় রাকাতের), তাহলে তাকবীর বলার জন্য আর রুকু থেকে ফিরে আসবে না এবং বিশুদ্ধ মতানুযায়ী রুকুতেও তাকবীর বলবে না। এক্ষেত্রে, যদি জামাত ছোট হয়, তবে নামায শেষে সিজদায়ে সাহু করবে।
উৎস: আততাজরীদ, কুদুরী ২/৯৮৬; আলমুহীতুর রেযাবী ১/৪১৬; আলবাহরুর রায়েক ২/১৬১; মিনহাতুল খালিক ২/১৪৭; রদ্দুল মুহতার ২/১৭৪
মাসআলা ৪: যদি ইমাম ভুলে রুকুতে চলে যাওয়ার পর তাকবীর আদায়ের জন্য রুকু থেকে ফিরে আসে, তাহলে যদিও কিছু ফকীহ নামায ফাসেদ হয়ে যাওয়ার মত দিয়েছেন, তবে বিশুদ্ধ মত অনুযায়ী এটি ভুল হলেও নামায নষ্ট হবে না।
উৎস: রদ্দুল মুহতার ২/১৭৪
মাসআলা ৫: হানাফী মাযহাবের অনুসারী যদি অন্য মাযহাবের ইমামের পেছনে নামায আদায় করে (যেমন, ইমাম যদি বারো তাকবীর বা অন্য কোনো সংখ্যা অনুসারে নামায পড়ান), তাহলে সে ইমামের অনুসরণে তাকবীর বলবে।
উৎস: কিতাবুল আছল ১/৩২৪; মাবসূত, সারাখসী ২/৪২; শরহুল মুনইয়া, পৃ. ৫৭২
ঈদের নামাযে মাসবুক হওয়া সংক্রান্ত মাসায়েল
যদি কেউ ঈদের নামাজে প্রথম রাকাতে ইমামের অতিরিক্ত তাকবীর বলার পর জামাতে শরীক হয়, তবে তাকবীরে তাহরীমা বলে নামাজে প্রবেশ করার পর নিজে নিজেই অতিরিক্ত তাকবীরগুলো সম্পন্ন করবে। এটি সে তখনও করতে পারবে, যখন ইমাম কেরাত পড়ছেন।
প্রমাণ:
সুফিয়ান ছাওরী (রাহ.) থেকে বর্ণিত:
وَلَوْ وَجَدَ الْإِمَامَ يَقْرَأُ كَبّرَ كَمَا يُكَبِّرُ الْإِمَامُ.
অর্থ: “যদি ইমামকে কেরাত অবস্থায় পাওয়া যায়, তবে সে (মুক্তাদী) ইমামের মতো তাকবীর আদায় করবে।”
📖 [মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক, বর্ণনা ৫৭১৪]
তবে, নামাজে শরীক হওয়ার পর দাঁড়ানো অবস্থায় (রুকুর আগে) অতিরিক্ত তাকবীর বলার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও যদি কেউ তা আদায় না করে, তাহলে পরে রুকুতে তাকবীর বলবে না।
📖 [আল-বাহরুর রায়েক ২/১৬১; রদ্দুল মুহতার ২/১৭৪]
ইমামের রুকুতে পাওয়া সংক্রান্ত মাসায়েল
মাসআলা: যদি কেউ ইমামকে রুকুতে পায় এবং প্রবল ধারণা হয় যে দাঁড়িয়ে অতিরিক্ত তাকবীর বললেও রুকুতে শরীক হতে পারবে, তাহলে তাকবীরগুলো বলে রুকুতে যাবে। তবে যদি ধারণা হয় যে তাকবীর বললে রুকু পাওয়া যাবে না, তাহলে তাকবীরে তাহরীমা বলে সরাসরি রুকুতে চলে যাবে। রুকুতে গিয়ে বাকি তাকবীরগুলো হাত না উঠিয়ে বলবে। এরপর সময় থাকলে রুকুর তাসবীহ আদায় করবে।
তথ্যসূত্র: আত-তাজরীদ, কুদুরী ২/৯৮৪; আল-মুহীতুল বুরহানী ২/৪৮৮-৮; আল-হাবীল কুদসী ১/২৪৩; আল-বাহরুর রায়েক ১/১৬১; আয-জাখীরাতুল বুরহানিয়া ২/৪০০; শরহুল মুনইয়া, পৃ. ৫৭২
মাসআলা: ইমামের রুকুতে শরীক হওয়ার পর অতিরিক্ত তাকবীর বলার সময় না পেলে তাকবীর পড়ার প্রয়োজন নেই। কারণ, রুকুতে শরীক হওয়ায় রাকাত ও তাকবীর উভয়ই পাওয়া হয়েছে বলে গণ্য হবে।
তথ্যসূত্র: ফাতাওয়া তাতারখানিয়া ২/৬১৮; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/১৫১
ছুটে যাওয়া রাকাত আদায় সংক্রান্ত মাসায়েল
মাসআলা: যদি কেউ দ্বিতীয় রাকাতে ইমামের সাথে শরীক হয়, তাহলে ইমামের সালাম ফেরানোর পর ছুটে যাওয়া রাকাত আদায়ের জন্য দাঁড়িয়ে প্রথমে সূরা-কেরাত পড়বে, তারপর রুকুর আগে অতিরিক্ত তাকবীর বলবে। অর্থাৎ, ছুটে যাওয়া রাকাতেও দ্বিতীয় রাকাতের মতো রুকুর আগে অতিরিক্ত তাকবীর পড়বে।
তথ্যসূত্র: মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা, হাদীস ৫৮১৩; কিতাবুল আছল ১/৩২২; আল-হাবীল কুদসী ১/২৪৪
মাসআলা: যদি কেউ দ্বিতীয় রাকাতের রুকুর পর এমনকি শেষ বৈঠকের তাশাহহুদের পরও জামাতে শরীক হয়, তবে সে ঈদের জামাত পেয়েছে বলে গণ্য হবে। ইমামের সালাম ফেরানোর পর দাঁড়িয়ে স্বাভাবিকভাবে উভয় রাকাত আদায় করবে।
তথ্যসূত্র: কিতাবুল আছল ১/৩২২; ফাতাওয়া খানিয়া ১/১৮৫; আল-মুহীতুল বুরহানী ২/৫০০
ঈদের নামাজে সাহু সিজদা
মাসআলা: সাধারণ নামাজের মতো ঈদের নামাজেও যদি কোনো ওয়াজিব ছুটে যায় এবং বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা না থাকে, তাহলে সাহু সিজদা দেওয়া উচিত। তবে ঈদের জামাতে সাধারণত বড় জমায়েত হয় এবং অনেক মুসল্লি সাহু সিজদার নিয়ম জানে না, তাই বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা থাকলে সাহু সিজদা মাফ হয়ে যাবে।
তথ্যসূত্র: কিতাবুল আছল ১/৩২৪; আল-মুহীতুল বুরহানী ২/৫০১
ঈদের নামাজের পর তাকবীরে তাশরীক
মাসআলা: ঈদুল আযহার নামাজের পর তাকবীরে তাশরীক বলা যেতে পারে। তবে এটি ফরজ নামাজের পরের মতো ওয়াজিব নয়।
তথ্যসূত্র: আল-বাহরুর রায়েক ২/১৬৫; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/১৫২; রদ্দুল মুহতার ২/১৮০
ঈদের খুতবা সংক্রান্ত মাসায়েল
মাসআলা: ঈদের নামাজের পর খুতবা দেওয়া সুন্নত এবং মুসল্লিদের তা মনোযোগ দিয়ে শোনা ওয়াজিব।
তথ্যসূত্র: কিতাবুল আছল ১/৩১৮; আল-হাবীল কুদসী ১/২৪২; বাদায়েউস সানায়ে ১/৬১৮
মাসআলা: ঈদের খুতবা দুইটি হয় এবং জুমার মতো দুই খুতবার মাঝে বসা সুন্নত।
তথ্যসূত্র: মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক, হাদীস ৫৬৪২; মাবসূত, সারাখসী ২/২৬২; বাদায়েউস সানায়ে ১/৬১৯
মাসআলা: ঈদের খুতবার আগে আজান দেওয়ার কোনো বিধান নেই।
মাসআলা: খুতবার সময় ইমাম তাকবীর দিলে মুসল্লিরা চুপ থেকে খুতবা শুনবে, নিজেরা তাকবীর বলবে না।
তথ্যসূত্র: মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক, হাদীস ৫৬৪২
ঈদের নামাজ ছুটে গেলে কি করবেন?
মাসআলা: ঈদের নামাজ কাযা করার বিধান নেই। কেউ যদি ঈদের নামাজ ছুটিয়ে ফেলে, তবে আশেপাশের অন্য কোনো ঈদের জামাতে শরীক হওয়ার চেষ্টা করবে। সম্ভব না হলে তওবা-ইস্তেগফার করবে।
তথ্যসূত্র: শরহু মুখতাসারিত তাহাবী ২/১৬১; আল-মুহীতুল বুরহানী ২/৪৯৮; আল-হাবীল কুদসী ১/২৪৪
ঈদের নামাজের আগে-পরে নফল নামাজ
মাসআলা: ঈদের নামাজের আগে বা পরে নফল নামাজ পড়া মাকরূহ।
তথ্যসূত্র: কিতাবুল আছল ১/৩২৮; আয-জাখীরাতুল বুরহানিয়া ২/৩৮১-৩৮২; শরহুল মুনইয়া, পৃ. ৫৬৭
বিবিধ মাসায়েল
মাসআলা: জুমার দিন ঈদ হলে উভয় নামাজই আদায় করতে হবে। ঈদের নামাজ পড়লে জুমা পড়তে হবে না—এ ধারণা ভুল।
তথ্যসূত্র: সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৫৭২; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৮৭৮
ঈদের নামাজ পুরুষদের জন্য ওয়াজিব, কিন্তু নারীদের জন্য নয়। সাহাবায়ে কেরাম মাসআলা: অনেকেই নারীদের ঈদগাহে যেতে নিরুৎসাহিত করেছেন।
তথ্যসূত্র: আল-আওসাত ৪/৩০১; মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা, হাদীস ৫৮৪৬
মাসআলা: কেউ যদি এক দেশে ঈদের নামাজ আদায় করে পরে অন্য দেশে গিয়ে আবার ঈদের জামাত দেখে, তাহলে দ্বিতীয়বার পড়া আবশ্যক নয়।
তথ্যসূত্র: ফাতাওয়া সিরাজিয়া, পৃ. ১৮