google-site-verification=rXaFmwSiYigXRnCfxubQMUMfWDLuTGq64pGk6OzeFd4

হজ্ব ও কুরবানীর ঐতিহাসিক তাৎপর্য:

 

কুরবানীর শাব্দিক অর্থ:

‘কুরবান’ قربان শব্দটি ‘কুরবুন’ মূল ধাতু থেকে নির্গত । যার অর্থ হলো- নৈকট্য লাভ করা, প্রিয় বস্তুকে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য উৎসর্গ করা।

কুরবানীর পারিভাষিক অর্থ:

শরিয়তের পরিভাষায়-নির্দিষ্ট জন্তুকে একমাত্র আল্লাহ পাকের নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট সময়ে নির্ধারিত নিয়মে মহান আল্লাহ পাকের নামে জবেহ করাই হলো কুরবানি।

কুরবানি ইসলামের অন্যতম এক নিদর্শন, তার হুকুমের ব্যাপারে ইমামদের মতবিরোধ রয়েছে। জমহুর উলামাদের নিকট সুন্নতে মুয়াক্কাদা, হানাফি মাযহাবের মতে ওয়াজিব।

সূরা আনআমের ১৬১-১৬৩ আয়াতে এবং সূরা কাউসারের ২ আয়াতে এই কুরবানী উল্লেখিত হয়েছে। বিস্তারিত বিধি-বিধান রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহতে  রয়েছে।

৪. সূরা আনআমে এসেছে-

قُلْ اِنَّنِیْ هَدٰىنِیْ رَبِّیْۤ اِلٰی صِرَاطٍ مُّسْتَقِیْمٍ ۚ۬ دِیْنًا قِیَمًا مِّلَّةَ اِبْرٰهِیْمَ حَنِیْفًا ۚ وَ مَا كَانَ مِنَ الْمُشْرِكِیْنَ۝۱۶۱ قُلْ اِنَّ صَلَاتِیْ وَ نُسُكِیْ وَ مَحْیَایَ وَ مَمَاتِیْ لِلّٰهِ رَبِّ الْعٰلَمِیْنَۙ۝۱۶۲ لَا شَرِیْكَ لَهٗ ۚ وَ بِذٰلِكَ اُمِرْتُ وَ اَنَا اَوَّلُ الْمُسْلِمِیْنَ۝۱۶۳

‘আপনি বলে দিন, আমার প্রতিপালক আমাকে পরিচালিত করেছেন সরল পথের দিকে-এক বিশুদ্ধ দ্বীনের দিকে, অর্থাৎ একনিষ্ঠ ইব্রাহীমের মিল্লাত (তরীকা), আর তিনি মুশরিকদের      অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না। আপনি বলুন, নিঃসন্দেহে আমার সালাত, আমার নুসুক, আমার জীবন, আমার মৃত্যু সবকিছুই রাববুল আলামীন আল্লাহর জন্য। তাঁর কোনো শরীক নেই।  আমাকে এই আদেশই করা হয়েছে, সুতরাং আমি হলাম প্রথম আত্মসমর্পণ কারী।’

এ আয়াতে ‘নুসূক’ শব্দটি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। এটি ‘নাসীকাহ’ শব্দের বহুবচন, যার অর্থ, আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিলের জন্য আল্লাহর নামে জবাইকৃত পশু। আর কুরবানীর স্থানকে আরবী ভাষায় এবং শরীয়তের পরিভাষায় ‘মানসাক’ বলা হয়। দুটো শব্দের মূল ধাতু অভিন্ন। আরবী ভাষার যেকোনো অভিধানে এবং লুগাতুল কুরআন, লুগাতুল হাদীস ও লুগাতুল ফিকহের যেকোনো নির্ভরযোগ্য কিতাবে ‘নুসুক’ শব্দের উপরোক্ত অর্থ পাওয়া যাবে।

হজ্ব ও কুরবানীর ঐতিহাসিক তাৎপর্য:

জিলহজ্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মাস। হজ্বের মাস। এ দিনগুলাের শ্রেষ্ঠত্বের একটি কারণ হলাে, এইদিনগুলােতে আল্লাহ হজ্ব ফরজ করেছেন। ৮ই জিলহজ্ব থেকে হজ্বের কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হবে, মানুষ ৮তারিখ মিনাতে অবস্থান গ্রহণ করবে। মিনা থকে ৯ তারিখ তারা আরাফার প্রান্তরে চলে যাবে। সারা দিন আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করে, সূর্য অস্ত যাওয়ার পর মাগরিবের নামাজ না পড়ে রওয়ানা হয়ে যাবে মুযদালাফার দিকে। মুযদালাফাতে মাগরিব এবং এশা একসাথে আদায় করবে এবং সেখানে অবস্থান গ্রহণ করবে। সকাল হওয়ার পর তারা আবার রওয়ানা হয়ে যাবে মিনাতে। মীনাতে গিয়ে তারা ‘জমরাতুল উকবা এর প্রতি পাথর নিক্ষেপ করবে সাতটি। তাহলে হজ্বের কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হবে ৮তারিখ থেকে। প্রশ্ন জাগে, এই দিনগুলােতে হজ্ব ও কোরবানী বা আল্লাহর রাস্তায় গরু, ছাগল, উট জবাই করার যে নির্দেশ আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের দিয়েছেন তার কারণ কি? এ সম্পর্কে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বিস্তারিত ঘটনা বর্ণনা করেছেন সুরা সাফফাতে যা সূরা ইয়াসীনের পরের সূরা। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন, কেন আমি এই দিনগুলােতে তােমাদের জন্য হজ্ব এবং কোরবানী সাব্যস্ত করেছি, তার কারণ কি? হজু এবং কোরবানির পিছনে একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আছে, আল্লাহর একজন বান্দাকে আল্লাহ এই দিনগুলােতে পরীক্ষা করেছেন। কঠিন ধরণের পরীক্ষা। আল্লাহ নিজেই বলেন, আমি আমার প্রিয় বান্দা, আমার খলীলকে পরীক্ষা করেছি। খলীল শব্দের অর্থ হচ্ছে অন্তরঙ্গ বন্ধু, খলীল ‘খুল্লাতুন’ শব্দ থেকে নির্গত হয়েছে। আমরা ইংরেজীতে বলি Core of heart (Core গভীর) অন্তরের উপরের চামড়াকে বলা হয় ‘খুল্লাতুন’ যার বন্ধুত্ব স্পর্শ করে অন্তরকে।) আল্লাহর প্রিয় বন্ধু হযরত ইব্রাহিম (আঃ)কে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পরীক্ষা করেছেন। পৃথিবীর বুকে এত কঠিন পরীক্ষা কেউ দেয়নি এবং কারাে থেকে নেয়াও হয়নি। এই ধরণের কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ বিশাল সফলতা তার ভাগ্যে জুটেছে। আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন বলেন, আমি যে পরীক্ষা ইব্রাহিম থেকে নিয়েছি, সে পরীক্ষা অত্যন্ত কঠিন পরীক্ষা।

هٰذَا لَهُوَ الْبَلَاءُ الْمُبِيْن

 

আল্লাহ নিজেই পরীক্ষক নিজেই বলে দিচ্ছেন, যিনি Question Paper সেট করেছেন, তিনিই  বলে দিচ্ছেন আমার এই পেপারে সবচেয়ে কঠিন প্রশ্ন রয়েছে। আল্লাহ বলেন, ইব্রাহিম হতে  যিলহজ্জের ৮তারিখ আমি যে পরীক্ষা নেওয়া শুরু করেছি অত্যন্ত কঠিন পরীক্ষা, স্পষ্ট পরীক্ষা। আমি তাকে বিরাট ধরনের বিপদে নিক্ষেপ করেছি। الْبَلَاءُ (বালা) শব্দের অর্থ হচ্ছে বিপদ, পরীক্ষা الْمُبِيْن মুবীন’ মানে সুস্পষ্ট বিপদ, সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন অন্য আয়াতে বলেন যে,  ইব্রাহিম থেকে আমি দশটি কঠিন পরীক্ষা নিয়েছি তার মধ্যে সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা যা নিম্নে  বর্ণিত হল, আল্লাহ বলেন,

 

قَالَ رَبِّ هَبْ لِيْ مِنَ الصَّالِحِيْنَ

 

৯০-১০০ বছরের বার্ধক্যে তিনি উপনীত হয়েছেন, কিন্তু কোন সন্তান নেই। আল্লাহর দরবারে  ফরিয়াদ করলেন “হে আল্লাহ আমাকে এক জন সুসন্তান দান করাে”। তাহলে আল্লাহর দরবারে  কারাে যদি সন্তান চাইতে হয়, তাহলে এভাবেই চাইতে হবে, যে ভাবে নবীরা চেয়েছেন এবং সন্তান  চাইতে হবে আল্লাহরই কাছে। নবীদের মাধ্যমে আমাদেরকে আল্লাহ শিক্ষা দিয়েছেন। হযরত  ইব্রাহিম (আঃ) বার্ধক্যে সন্তান চেয়েছেন। কার কাছে চেয়েছেন? আল্লাহর দরবারে চেয়েছেন।  কাজেই সন্তানের প্রার্থনা একমাত্র আল্লাহরই কাছে করতে হবে। কোন মানুষের কাছে, কোন  তাবিজ ব্যবসায়ির কাছে, কোন বদতদ্বীর বাজের কাছে সন্তান চাওয়া যাবেনা। কারণ, নবীরা তা  করেননি।

 

হযরত ইব্রাহিম (আঃ) বলেন, হে আমার রব, হে আমার পরওয়ারদিগার, হে আমার প্রতিপালক, আপনার  কাছেই ফরিয়াদ رَبِّ هَبْ لِيْ مِنَ الصَّالِحِيْنَ আমাকে সুসন্তান দান করুন। একমাত্র আল্লাহর কাছেই চাইতে হবে। চাওয়ার ভাষা হবে- হে আল্লাহ, আমাকে সুসন্তান দাও। নবীরা কখনাে বলেননি, আমাকে সন্তান দাও। কোন আয়াতে এমন নেই। হযরত জাকারিয়া (আঃ) বার্ধক্য অবস্থায় আল্লাহর দরবারে সৎ সন্তান চেয়েছেন। আল্লাহ তাকে পূত্র হিসেবে হযরত ইয়াহয়া (আঃ)কে দান করেছেন। হযরত ইব্রাহিম (আঃ)। বার্ধক্যে আল্লাহর দরবারে সন্তান চেয়েছেন, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাকে সন্তান দান করেছেন। কেউ এই কথা আল্লাহর দরবারে বলেননি, হে আল্লাহ আমাকে সন্তান দাও। হযরত যাকারিয়া (আঃ) মরয়ম (আঃ)কে  ( যার বাবা নেই, এতীম মেয়ে) যখন বায়তুল মােকাদ্দাসের বিশেষ একটি কক্ষের মধ্যে লালন পালন করার জন্য রেখে আসতেন, খাবার দিয়ে আসতেন এবং মাঝে মাঝে তিনি যখন মরয়ম (আঃ)কে দেখতে যেতেন সেখানে তিনি অমৌসুমী ফল দেখতে পেতেন। তিনি অবাক হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করতেন,

 

 

اَنّٰی لَکِ ھٰذَا

হে মরয়াম! বে মৌসুমী এই ফল তুমি কোথায় পেলে?

قَالَتْ ھُوَ مِنْ عِنْدِ اللہ

এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে আল্লাহই পাঠিয়েছেন। তখন যাকারিয়া (আঃ) এর মনে এই ভাবনা উদ্রেক হলাে যে, আল্লাহ মৌসুম ছাড়া ফল দিতে পারেন। আমের মৌসুম নয় আম দিতে পারেন, কাঠালের মৌসুম নয় কাঠাল দিতে পারেন। সে আল্লাহ বে মৌসুমে সন্তানও দিতে পারেন। আমি যাকারিয়া বৃদ্ধ হয়ে গেছি। এখন মৌসুম নেই বাচ্চার, বাচ্চা পাওয়ার মতাে উপযুক্ততা নেই, তার পরও আল্লাহ যদি চান তাহলে তিনি বাচ্চা দিতে পারেন। তখন তিনি মরয়মের কক্ষে এই ঘটনা দেখে আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করতে বসেন,

رَبِّ هَبْ لِيْ ذُرِّيَّةً طَيِّبَةً

“হে আমার প্রভু, আমাকে সু-সন্তান দান কর। কোরআনে কারীমের মধ্যে আছে رَبِّ هَبْ لِيْ ذُرِّيَّةً طَيِّبَةً হযরত যাকারিয়া (আঃ) আল্লাহর দরবারে দোয়া করলেন, হে আল্লাহ, আমাকে পবিত্র সন্তান দান কর। (শুধুসন্তান নয়) নবীরা আল্লাহর দরবারে সুসন্তান কামনা করেছেন। ভাল সন্তান কামনা করেছেন। কাজেই সন্তান চাওয়া এটা নবীদের সুন্নাত, সন্তানের প্রতি আগ্রহী হওয়া নবীদের আদর্শ। যার ছেলে-মেয়ে নেই তার অন্তরে যদি আগ্রহ জাগে। আমার যদি একটি সন্তান হতাে, এই আগ্রহ মন্দ কিছু নয়, বরং ভাল। নবীদের মধ্যেও তা ছিল। তবে এই আগ্রহের কথা শুধুমাত্র আল্লাহরই কাছে বলতে হবে। আল্লাহর কাছে বলতে হবে, হে আল্লাহ আমাকে সুসন্তান দাও। নেক্কার সন্তান দাও। শুধু সন্তান চাইলেই চলবেনা। সে সন্তান দিয়ে আপনি কি করবেন যে সন্তান আপনার কপালে কালিমা লেপন করবে? যে সন্তানকে কষ্ট করে লালন-পালন করার পর সেই সন্তান আপনাকে জাহান্নামে দেয়ার জন্য আল্লাহর দরবারে আপিল করবে। এ জন্যে নবীরা শুধু সন্তান চাননি। নবীরা চেয়েছেন সুসন্তান।

এ দোয়ার পর আল্লাহ রাব্বুল আলামীন জানিয়ে দিচ্ছেন,

فَبَشَّرْنَاہُ بِغُلَامٍ حَلِیْمٍ

যে হ্যাঁ, আমি ইব্রাহিমকে সুসংবাদ দিলাম। অত্যন্ত ধৈৰ্য্যশীল ভদ্র, গম্ভীর, মর্যাদাবান সন্তানের। বার্ধক্য অবস্থায় তিনি অত্যন্ত আনন্দিত। সন্তান দুনিয়াতে এসেছে। বার্ধক্যের এই সন্ত নিকে পাওয়ার পর তিনি আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করলেন। আর স্বাভাবিক কারণে সন্তানের প্রতি তার মন ছিল দয়াপ্রবণ। মনের সব আদর মায়া মমতা, সে সন্তানের জন্য নিবেদিত ছিল। এবার শুরু হল পরীক্ষার পালা। বাচ্ছা বাবার সাথে হাঁটতে শুরু করল, এসময় হল আদর কেড়ে নেওয়ার বেশি উপযুক্ত সময়। ঠিক তখনই আল্লাহ পাক হযরত ইব্রাহিম (আঃ)কে পরীক্ষা শুরু করলেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাকে স্বপ্নে দেখালেন। হে ইব্রাহিম, তােমাকে আমি সন্তান দিয়েছি। আমার দরবারে সেটা জবাই করে কোরবান দাও। তিনি প্রথমে মনে করলেন যে, এটা সম্ভবত শয়তানের কুমন্ত্রণা। তাফসীরে কুরতুবীতে বিশ্লেষণ রয়েছে, দ্বিতীয় দিন তিনি আবারাে  দেখলেন আরাে নিশ্চিত করার জন্য তৃতীয় দিন আল্লাহ আবার তাকে দেখালেন  এবং এটা স্বতঃসিদ্ধ

رُؤْیَا الْانْبِیَاء وَحْیٌ

নবীদের স্বপ্ন মিথ্যা হতে পারেনা, তা সত্য এবং ওহী, তা শয়তানের কুমন্ত্রণা নয়। আল্লাহর পক্ষ থেকে এটা ছিল নির্দেশ। সুনিশ্চিত হয়ে যাওয়ার পর তিনি বাচ্ছাকে বল্লেন: یٰبُنَیَّ এ হে আমার আদরের পুত্র, শব্দ হচ্ছে খুব আদরের ডাক। • হে আমার প্রিয় পুত্র

َإِنِّي أَرٰى فِيْ الْمَنَامِ أَنِّي اَذْبَحُك

আমি যেন দেখছি । বলা দরকার ছিল আমি দেখেছি। কিন্তু তিনি বলেছেন, দেখছি এখানে ব্যবহার করা  দরকার ছিল অতীত কালের শব্দ। (গতকাল রাতে আমি দেখেছি। কিন্তু তিনি তা বলেননি। তিনি  বলেছিলেন, আমি যেন দেখছি, এখন দেখছি ও মানে এই স্বপ্ন সুস্পষ্ট স্বপ্ন, এটা দেখা হয়ে যায়নি, এখনাে  আমার চোখের উপর স্বপ্নটি ভাসছে। আমি এখনাে দেখতে পাচ্ছি। স্বপ্নে আমি দেখছি | আমি তােমাকে  জবেহ করছি, সন্তানকে সরাসরি বলে দিলেন। এখন তােমার কাছে আমার জানার বিষয় فَانْظُرْ এবিষয়ে তুমি চিন্তা কর, তােমার মতামত কি? তুমি কি মনে কর? প্রশ্ন জাগে: আল্লাহ তাে নির্দেশ দিয়েছেন, আবার সন্তানের  মতামত নেওয়ার কি দরকার। আল্লাহর নির্দেশ তাে অবশ্যই পালন করতে হবে। সন্তান থেকে আবার  মতামত নেওয়ার কারণ কি? এর বড় এক কারণ হলাে যে, এটা সন্তানের জন্যেও আল্লাহর পরীক্ষা ছিল, শুধু বাবার জন্য নয়। সন্তান কি মতামত পেশ করে আল্লাহ জানতে চান। এজন্যে সন্তান থেকে হযরত  ইব্রাহিম (আঃ) জিজ্ঞেস করলেন। সন্তানও সাথে সাথে বল্ল,

 

قَالَ یٰاَبَتِ افْعَلْ مَا تُؤْمَرُ

হে বাবা, এটাও বাবাকে খুব আদর করে ডাকার শব্দ । যা কিছু আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সেটাই আপনি করুন। কোন রকম সন্দেহ বা দ্বিধা প্রকাশ করেনি। আমাকে আপনি জবাই করবেন? আমার পক্ষ থেকে আপনাকে  সার্বিক সহযােগিতা দেয়া হবে।

ستجدني إنشاء الله من الصبرين

 

কুরবানীর বিধান ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ?

আপনি যখন আল্লাহর নির্দেশ পালন করতে যাবেন, আমার পক্ষ থেকে আপনি কোন বাধা পাবেন না। তাফসীর গ্রন্থে আছে, যখন মাকে বলে সন্তানকে নিয়ে যাচ্ছে মা বিষয়টি জানেনা। তখন শয়তানের মাথা খারাপ হয়ে গেল। সে বল্ল: ইব্রাহিমের পরিবারকে যদি এই মুহূর্তে আমি বিভ্রান্ত করতে না পারি তাহলে এই পরিবারকে আমি আর কখনাে প্ররােচিত করতে পারবােনা। ধোকা দিতে পারবােনা। এটাই হচ্ছে সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। তিনি স্বপ্ন দেখেছেন জিলহজ্বের ৮, ৯ এবং ১০ তারিখ রাতে। তার পরে ১০ তারিখ দিনের বেলায় তিনি তাকে জবাই করতে নিলেন।

হজ্ব শুরু হয় ৮তারিখ থেকে। স্বপ্নও শুরু হয়েছে ৮তারিখ। আট তারিখকে ) یومُ التَّرْویہ তারবিয়া দিবস বলা হয়। ২য় বার ৯তারিখ রাতে ও ৩য় বার ১০ তারিখ রাতে। তিনরাতে তিনি স্বপ্নটি দেখলেন।

ইসমাইলের পরীক্ষায় শয়তান ধোকাবাজি করতে গিয়ে ব্যার্থ হয়েছে:

শয়তান ইব্রাহিমের স্ত্রীর কাছে গিয়ে বল্ল: তুমি কি জান তােমার সন্তনকে সন্তানের বাবা কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? মহিলা বল্লঃ কোন প্রয়ােজনে হয়তাে বাপ-পুত্র বের হয়েছে। শয়তান বল্লঃ না, তাকে জবাই করার জন্য নেয়া হচ্ছে। তােমাকে জানানাে হয়নি। হযরত ইব্রাহিমের স্ত্রী বলেন, তিনি একজন দয়াবান পিতা। আল্লাহর কাছে চেয়ে সন্তান নিয়েছেন। তিনিই তাকে জবাই করবেন এটাতাে কল্পনাও করা যায়না। হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর স্ত্রীর সুন্দর উত্তর। তুমি বলছ যে, সন্তানকে জবাই করার জন্য বাবা নিয়ে যাচ্ছে। অথচ এই বাবা আল্লাহর কাছে কত ফরিয়াদ করে সন্তানটি চেয়ে নিয়েছেন। আবার তিনিই জবাই করে দিবেন এটাতাে অসম্ভব ব্যাপার। শয়তান বল্ল : হ্যাঁ এটা কল্পনা করা যায়না। কিন্তু ইব্রাহিম (আঃ) ধারনা করছে যে আল্লাহই নাকি তাঁকে নির্দেশ দিয়েছেন জবাই করার জন্য। এর পর হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর স্ত্রী বল্লেন- যদি আল্লাহই নির্দেশ দিয়ে থাকেন তাহলে তাে তাঁকে জবাই করতেই হবে। যে আল্লাহ সন্তান দিয়েছেন তিনি যদি জবাই করতে বলেন, তাহলেতাে অবশ্যই জবাই করতে হবে। এতে আমার কোন আপত্তি নেই। আর আল্লাহ না বল্লে ইব্রাহিম (আঃ) শুধু শুধু জবাই কেন করবে।

শয়তান ইব্রাহিম (আঃ) এর স্ত্রীর কাছে সুযােগ না পেয়ে সন্তানের কাছে আসল, সন্তানের কাছে আসার পর বল্লঃ তুমি কি জান? তােমার বাবা তােমাকে কোথায় নিয়ে যায়? সন্তান বল্ল যে, আমার বাবার সাথে কাজে যাচ্ছি। তুমি যেয়ােনা তােমাকে জবাই করে ফেলবে। সন্তান বল্ল- আমার বাবা কেন আমাকে জবাই করবে ? শয়তান উত্তরে বল্ল যে, তােমার বাবার মাথায় ঢুকেছে যে, আল্লাহ নাকি তাকে স্বপ্নে দেখিয়েছে, তােমাকে জবাই করতে হবে, এজন্যেই তােমাকে জবাই করবে। ঈমানী পরিবেশে গড়ে উঠা পরিবার ছিল ইব্রাহিমের পরিবার। ঈমানের ভিত্তিতে যে সংসার বিকশিত হয়েছে তার সদস্যের আস্থা ছিল সুদৃঢ়, মজবুত। স্ত্রীর কাছে শয়তান সুযােগ পায়নি। সন্তানকে যখন এটা বল্ল, সন্তান কি বল্ল? আল্লাহ যদি নির্দেশ দিয়ে থাকেন অবশ্যইতাে তিনি জবাই করবেন। তাতে মাথা দেওয়ার আমার কি অধিকার আছে, আমাকে জবাই করুক। এবার বাবার কাছে এসে হযরত ইব্রাহিম (আঃ)কে ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা করছে শয়তান। সে হতাশ। সর্বশেষ হযরত ইব্রাহিম (আঃ)কে বল্ল যে, আসলে তুমি যে স্বপ্ন দেখেছ এটা শয়তান তােমাকে দেখিয়েছে। আল্লাহর পক্ষ থেকে এই স্বপ্ন ছিলনা। এটা শয়তান তােমাকে দেখিয়েছে। ইব্রাহিম (আঃ) বুঝে গেছেন যে, শয়তান আমাকে ধোকা দিচ্ছে। প্রথম বার তাঁকে ধোকা দেওয়ার জন্য যে জায়গায় আসে, হযরত ইব্রাহিম (আঃ) পার্শে এক মুঠো পাথর পেলেন, ছােট ছােট কংকর। একমুঠে সাতটি পাথর ছিল। কসম করে মারতে লাগল। যাও, তুমি শয়তান। আমাকে ধোঁকা দেওয়ার জন্যে, আল্লাহর নির্দেশ পালনে বাধা সৃষ্টি করার জন্যে তুমি এসেছ। সাতটি পাথর তাকে মারল। এটাকে বলা হয় জুমরাতুল উকবা’। এখানে হাজী সাহেবরা ৭টি পাথর নিক্ষেপ করেন হজ্বের সময়। আসলে এখানে শয়তান দাঁড়িয়ে আছে তা নয়। বরং এটা হচ্ছে একটি সিম্বল, নিদর্শন। স্মরণ করতে হবে যে, এই জায়গায় হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর মতাে নবীকে শয়তান প্রতারিত করতে চেষ্টা করেছে আর হযরত ইব্রাহিম (আঃ) তার সাধ্যে পাথর ছিল বলে পাথর নিক্ষেপ করে শয়তানের ‘ওয়াসওয়াসা’ দূর করতে চেষ্টা করেছেন। আল্লাহর দরবারে এই কাজ এতই পছন্দ হয়েছে যে, কেয়ামত পর্যন্ত প্রতিবছর এই দিনে এই জায়গায় লক্ষ লক্ষ হাজী সাহেবকে আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন, আমার খলিল যে কাজ করেছে আমার কাছে বড়ই ভাল লেগেছে। তােমরাও পাথর মারাে। এজন্যে প্রতিটি হাজী সাহেবকে পাথর মারতেই হয়। যদি কেউ ইচ্ছাকৃত পাথর না মারে তাহলে তার হজ্বই আদায় হবেনা। এটা আল্লাহর নিকট প্রিয় কাজ। মিনায় একটি স্তম্ভ আছে যার চতুর্দিকে ঘেরাও করা। সেখানে পাথর নিক্ষেপ করতে হয়। এখানেই শয়তান দাঁড়ানাে আছে একথা বুঝার ভুল এবং এই পিলারকে শয়তান মনে করে পাথর মারাও ঠিক নয়। এটি একটি চিহ্ন মাত্র। একটি প্রতীক। অনেককে দেখা যায় সেখানে গেলে জজবা এসে যায়, পায়ের জুতা খুলে মেরে দেয়। সে জায়গায় অনেক জুতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। এগুলাে ইসলাম সমর্থন করেনা। সেখানে জুতা মারতে বলা হয়নি। হযরত ইব্রাহিম (আঃ) জুতা মারেননি। হযরত ইব্রাহিম (আঃ) মেরেছেন পাথরের কংকর। কাজেই সেখানে কংকর নিক্ষেপ করতে হবে। অন্য কিছু নিক্ষেপ করলে হজ্জ আদায় হবেনা। কংকর না ছুঁড়ে কেউ যদি সাতটি জুতা ছুঁড়ে তার হজ্জও আদায় হবেনা। অনেক ধরনের ময়লা জিনিষ সেখানে দেখা যায় এগুলাে হচ্ছে অজ্ঞতা প্রসুত কাজ।

হযরত ইব্রাহিম (আঃ) সন্তানকে নিয়ে একটু অগ্রসর হওয়ার পর শয়তান আবার আসল মিনাতে। হযরত ইব্রাহিম (আঃ) সেখানেও পাথর ছুঁড়ে মারলেন সাতটি। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সে জায়গাতেও পাথর মারার জন্য হাজীদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন। একটু পরে। তৃতীয় বার শয়তান আবার যখন আসল, সেখানেও তিনি সাতটি পাথর মেরেছেন। সেখানেও পাথর মারতে হয়। তিনবার কোন চান্স না পেয়ে হযরত ইব্রাহিম (আঃ) তার সন্তানকে কোন কোন বর্ণনা অনুযায়ী মীনাতে কোরবান করার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন।

ইসহাক নয়, ইসমাঈলকে কোরবান করার নির্দেশ এসেছেঃ

আল্লাহর খলীল হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর সন্তান হযরত ইসমাঈল (আঃ)কে কোরবান করার জন্য চেষ্টা করা হয়েছে; কোরআনের ভাবধারায় এটাই বুঝা যায়। কারণ হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর প্রথম সন্তান হলেন হযরত ইসমাঈল (আঃ), হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর দু’জন স্ত্রী ছিল। একজন হলেন তার দাসী হাজেরা (আঃ), তার থেকে যে সন্তান হয় তার নাম ছিল ইসমাঈল, আর অন্য স্ত্রী সারা, তার থেকে যে সন্তান হয়, তার নাম হল ইসহাক। তবে ইসহাক হল পরে আর ইসমাঈল (আঃ) হল প্রথম সন্তান। বাইবেলেও এ তথ্য বর্ণিত হয়েছে। আর যুক্তিও তাই বলে। বার্ধক্য অবস্থায় প্রথম যে সন্তান হয়েছে তার প্রতিই বেশি ভালবাসা থাকে, তাকে যদি কোরবানি করতে বলা হয় তখনই মন বেশি কষ্ট পাবে। এটাই স্বাভাবিক আল্লাহ যেহেতু বলেছেন এটা স্পষ্ট পরীক্ষা কাজেই ২য় সন্তানের ক্ষেত্রে এই পরীক্ষা ছিল না। এই পরীক্ষা ছিল প্রথম সন্তানের ক্ষেত্রে। এটা আমাদের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেও আমরা উপলব্ধি করতে পারি।

একজন বাবার যখন কয়েকজন সন্তান হয় সবচেয়ে বেশি মমতা, মায়া ও আগ্রহ থাকে প্রথম সন্তানের প্রতি, এটা স্বাভাবিক। কারণ প্রথমবারই নতুন অভিজ্ঞতা হয় যে, সন্তানের বাবা হচ্ছেন তিনি। কাজেই আল্লাহ যে সন্তানকে জবাই করার নির্দেশ দান করেছেন তিনি ইসহাক ছিলেন না। তিনি ছিলেন হযরত ইসমাঈল (আঃ)।  ঈমান দ্বীপ্ত সন্তান হযরত ইসমাঈলের (আঃ) অন্তরে ঈমানের আলাে জ্বলছে,

কুরবান হওয়ার জন্য বাবার প্রতি সন্তানের পরামর্শ:

হযরত ইসমাঈল (আঃ) সর্বাত্মক সহযােগিতার আশ্বাস দিয়ে তার বাবাকে বলেন, বাবা- আমি আপনাকে পরামর্শ দিচ্ছি, আপনি আমাকে জবাই করার সময় আপনার কাপড়কে ভাল করে গুটিয়ে ফেলবেন। কারণ, জবাই করার পর ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হবে আর সে রক্ত যদি আপনার জামায় লাগে এবং রক্ত নিয়ে যদি বাড়িতে ফিরে যান, আমার মা যদি সে রক্ত দেখে তিনি

 সহ্য করতে পারবেন না। কাজেই আপনি আমাকে জবাই করার আগে আপনার জামাকে সরিয়ে রাখবেন। তাছাড়া আমাকে শােয়ানাের সময় সােজাভাবে শুইয়ে আমার গলায় আপনি ছুরি দেবেন না। কারণ আপনি সােজা করে শুইয়ে যদি আমাকে জবাই করেন আমার চেহারার দিকে আপনার দৃষ্টি পড়লে আপনার জন্য ছুরি চালানাে অত্যন্ত কঠিন হবে। আমাকে উপুড় করে ফেলবেন এবং গলার পিছন থেকে আমাকে জবাই করবেন। তৃতীয়ত: ছুরি ভাল করে ধার দিয়ে নিবেন। যাতে জবাই শুরুর সাথে সাথে কাজ সেরে যায়। যত দেরি হবে অত বেশি আপনার কষ্ট হবে।

এই পরামর্শ গুলাে দিয়েছিল বাবাকে সন্তান। যিনি জানেন যে এখন জবাই হয়ে যাবে, তারা জানতেন না যে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আসল জবাই চান না। বাবা এবং পুত্র তারা। দুজনেরই ধারণা, আল্লাহ জবাই চাচ্ছেন, রক্ত চাচ্ছেন। কাজেই দিতেই হবে। এই পরীক্ষা ছিল লােমহর্ষক, কঠিন। আল্লাহ নিজেই যাকে কঠিন পরীক্ষা বলে অভিহিত করেছেন। একজন ঈমানদারকে সারাজীবন অসুস্থতা দিয়ে বা অভাব দিয়ে যদি আল্লাহ পরীক্ষা করেন, সে পরীক্ষার সাথে এই ১ ঘন্টার পরীক্ষার কোনই তুলনা হতে পারেনা। আর এই পরীক্ষা আল্লাহর দরবারে এতই প্রিয় হয়েছে যে, কেয়ামত পর্যন্ত আল্লাহ প্রতি বৎসর চান তার বান্দারা ওটাকে আবার যেন রূপায়িত করে দেখায়।

আর হযরত ইব্রাহিম খলিলের স্মৃতি আল্লাহ হজ্জের মাধ্যমে ধরে রেখেছেন। হজ্ব মানেই হচ্ছে হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর স্মৃতি। তিনি বাইতুল্লাহ নির্মাণ করেছেন। আল্লাহর নির্দেশে মা এবং সন্তানকে ফেলে তিনি চলে গেলেন। মা পানির জন্য ছুটাছুটি করছে, আল্লাহর দরবারে তা ছিল অত্যন্ত প্রিয়। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হাজীদেরকে বলেন, যাও ছফা মারওয়াতে ৭বার দৌড়াদৌড়ি কর। আমার প্রিয় খলীল তাঁর স্ত্রীকে ফেলে আসার কারণে তাঁর স্ত্রী সন্তানের পানির জন্য ছুটাছুটি করেছেন। তােমরাও ছুটাছুটি কর। তার পরে জমজমের পানি পেয়েছেন। সন্তানের পা থেকে জমজমের পানির একটি ঝর্ণধারা তিনি দেখতে পেলেন, অবাক হলেন। আল্লাহ বলেন, তােমরাও যাও পানি পান করে আস। অর্থাৎ পুরা ঘটনাকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন প্রতি বছর হাজীদের মাধ্যমে আবার যেন অভিনীত করে থাকেন। আল্লাহর দরবারে খলীলের কোরবানি অত্যন্ত প্রিয় হয়েছে। জবাই করতে যখন লাগলেন, তখন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন, হে জিবরীল : তুমি বসে আছ? তুমি তাড়াতাড়ি যাও। হযরত ইব্রাহিম (আঃ) ছুরিকে অত্যন্ত ধারালাে করলেন, তাফসীরে কুরতবীতে আমি এই ঘটনা পড়েছি। ঘটনা গুলাে বিশুদ্ধ সনদ দ্বারা প্রমানিত না হলেও তাফসীরে ঘটনাগুলাে বর্ণনা করা হয়েছে। এটা ঐতিহাসিক ঘটনা। বিশুদ্ধ সনদের মাধ্যমে বর্ণিত নয়।

ইসমাইলের গলায় ছুরিতে আল্লাহর কুদরত:

বর্ণনায় আছে, ছুরির ধারালাে দিক দিয়ে তিনি কাটতে চেষ্টা করেন। কিন্তু ছুরি বার বার উল্টে যায় এবং ধারালাে দিক না চলে উল্টো দিকটি চলতে থাকে। তাতে কিছুই হয়না, অপর এক বর্ণনায় আছে, পিঠের পিছনের দিকে সামান্য ছােট ছােট লােম ছিল, ঘাড়ের কেশ। সে গুলাে কেটে গেল। তিনি অবাক হয়ে দেখলেন যে এক পোচ দেওয়ার পর একটু কাটে ছুরি ফিরিয়ে আনার পূর্বেই তা জোড়া লেগে যায়।

বার বার ছুরি চালানাের চেষ্টা করেন, কিন্তু বারবার একটু লােম কাটা যায় পরে আবার তা জোড়া লেগে যায়। তিনি অদ্ভুত ব্যাপারটি চিন্তা করলেন, কি ব্যাপার, আল্লাহ কি আমার কোরবানি গ্রহন করছেন না? তিনি অস্থির হয়ে পড়লেন, এবং আরাে জোরে জবেহ করতে লাগলেন। হযরত জিবরীল যখন আল্লাহর নির্দেশ পেয়ে নামলেন, আল্লাহ বলেন,

وفدیناه بذبح عظیم

আমি তার জন্যে বড় আকারের এক জন্তুকে প্রেরণ করে দিলাম। জান্নাত থেকে আমি তার জন্য বড় আকারের জন্তু প্রেরণ করলাম। আমার খলিল যখন কোরবান করতে নেমেছেন কোরবান করবেনই, তবে তার সন্তান নয়, জন্তুটিকে তিনি জবাই করবেন। হযরত ইব্রাহিমতাে ছুরি চালানাে নিয়ে ব্যস্ত, তিনি এদিক ওদিক তাকাননি। হযরত জিবরায়ীল উপর থেকে আওয়াজ দিয়ে আসেন। আল্লাহু আকবর’ ‘আল্লাহু আকবর’ বলে তিনি চিৎকার করে নামলেন। আর আল্লাহর ডাক শুনে নিচ থেকেই হযরত ইসমাঈল (আঃ) বল্লেন- লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবর’ তার পর তারা সকলে পড়লেন আল্লাহু আকবর ওয়া লিল্লাহিল হামদ’। মহান আল্লাহরই জন্য সকল প্রশংসা। এর পর হযরত জিবরীল (আঃ) বল্লেন-হে আল্লাহর খলিল, আল্লাহ আপনার এই কাজকে অত্যন্ত পছন্দ করেছেন। আল্লাহ নিজেই ডাক দিয়ে বলেন,

وناديناه أن یَّا ابراهیم

আমি ইব্রাহিমকে ডেকে বল্লাম, হে ইব্রাহিম- তুমি যা স্বপ্ন দেখেছিলে সে স্বপ্নকে পুঙখানুপুঙখ ভাবে তুমি বাস্তবায়ন করতে পেরেছ, তােমার পরীক্ষার রেজাল্ট প্রকাশ হয়ে গেল। তুমি উত্তীর্ণ ।

আল্লাহ নিজেই ঘােষণা করেন:

قَدْ صَدَّقْتَ الرُّؤْيَا اِنَّا كَذٰلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِيْنَ

 

“আমি এভাবেই তােমাকে তােমার কাজের প্রতিদান দেব, যেভাবে সৎ মানুষদেরকে আমি তাদের কাজের প্রতিদান দিয়ে থাকি।” তুমি পাশ করেছ এবং জেনে রাখ তােমার এই পরীক্ষা ছিল কঠিন পরীক্ষা। একটি ভেড়া আল্লাহ প্রেরণ করেছেন। এ কারণে অনেক আলেম এই মতামত দিয়েছেন যে, গরু-ছাগল কিংবা উট কোরবানীর চেয়ে ভেড়া কোরবানি করা ভাল। যেহেতু আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর সন্তানের পরিবর্তে যে জন্তুকে প্রেরণ করেছিলেন সে জন্তু ছিল ভেড়া। তবে অন্যান্য জন্তু দিয়েও কোরবান করলে হয়ে যাবে। অন্য বর্ণনায় আছে কোরবানিকৃত জম্ভর গায়ের মধ্যে যতগুলাে পশম অতগুলাের বিনিময়ে আল্লাহ তাকে ছােয়াব দান করবেন। যেহেতু ভেড়ার পশম সবচেয়ে বেশি এজন্য ছােয়াবও বেশি পাওয়া যায় আল্লাহ রাব্বল আলামীন বলেন –

وتركنا عليه في الآخرين

এ কাজ আমার এতই ভাল লেগেছে যে, পরবর্তী সকলের মাঝে এ কাজকে আমি অব্যাহত রেখেছি। হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর স্মরণ কেয়ামত পর্যন্ত যত মানুষ আসবে সবাইকে করতে হবে। আল্লাহ রাব্বল আলামীন এ ঘটনা বর্ণনা করে বলেন,

سلام علی ابراهیم

ইব্রাহিমের জন্যে অভিবাদন। আল্লাহর পক্ষ থেকে শান্তি ও শুভেচ্ছা। যারাই হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর মত এখলাস নিয়ে আল্লাহকে রাজি খুশি করার জন্যে কোরবানি করবে তাদের প্রতিও সালাম। তাদের জন্যেও আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত এবং বরকত। এ জন্য আল্লাহ রাব্বল আলামীন আমাদের মধ্যে যাদেরকে সামর্থ দিয়েছেন তাদের কোরবান করা ওয়াজিব। যিলহজ্বের ১০ তারিখ, না পারলে ১১ তারিখ, না পারলে ১২ তারিখ পর্যন্ত কোরবানি করা যায়। তিন দিন পর্যন্ত কোরবান করা যায়। মুসলমান, প্রাপ্ত বয়স্ক, সুস্থ এবং যাদেরকে আল্লাহ সচ্ছলতা দান করেছেন, সে দিন যাদের কাছে সাড়ে বায়ান্ন তােলা রূপার পরিমান টাকা অতিরিক্ত থাকবে তার উপর কোরবান করা ওয়াজিব হয়ে যাবে। তাঁকে কোরবান করতেই হবে। আর কোরবান করতে হবে ঈদের নামাজের পর।

আল্লাহর নবী সতর্ক করে বলেছেন –

من لم يضحي فلا يقربن مسجدنا

যে ব্যক্তি সচ্ছল অথচ কোরবান করেনা, সে যেন আমাদের মসজিদে উপস্থিত না হয়।

 

 

অন্য রেওয়ায়াতে আছে
فَلَا یَقْرّبَنَّ مُصَلّانا

যে ব্যক্তি সচ্ছলতা থাকার পরেও কোরবান করেনা, সে যেন আমার ঈদগাহেও উপস্থিত না হয়।কাজেই সামর্থবান ব্যক্তিদেরকে হযরত ইব্রাহীমের স্মৃতিবাহী কোরবান করার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। হে আল্লাহ ! আমাদের আমল করার তাওফিক দান করুন। আমীন।

 

Thank you for reading the post.

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top