google-site-verification=rXaFmwSiYigXRnCfxubQMUMfWDLuTGq64pGk6OzeFd4

তাওবার গুরুত্বপূর্ণ আলোচা | সাহাবীদের তাওবাহ্ কবূলের ঘটনা |

 

তাওবার আলোচনা

অনুসৃত গ্রন্থ: রিয়াযুস সালেহীন ; অনুচ্ছেদ দুই: তাওবার বিবরণ।  ইমাম গাযালি (রাঃ) এর মুকাশিফাতুল কুলূব

তাওবার গুরুত্বপূর্ণ আলোচা | সাহাবীদের তাওবাহ্ কবূলের ঘটনা |

তওবার বিবরণ সম্পর্কে আলেমগণ বলেন, প্রতিটি গুনাহ থেকেই তওবা করা অবশ্য কর্তব্য (ওয়াজিব)। আমরা বিভিন্ন সময়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগের স্বীকার হই, এই পরিস্থিতিতে মুমিনের করণীয় কি? করনীয় হলো তাওবাহ করা। যদি কোনো গুনাহ আল্লাহ ও বান্দার মধ্যকার বিষয় হয়, এবং তার সাথে কোনো বান্দার হক সম্পৃক্ত না থাকে, তবে তা থেকে তওবা করার জন্যে তিনটি শর্ত অবশ্য পালনীয়।

 তাওবার শর্ত:

  • ·        প্রথম শর্ত হলো, বান্দা/বান্দিীকে গুনাহ থেকে বিরত থাকতে হবে। অর্থাৎ গুনাহ্ এর কাজ বন্ধ রাখতে হবে।
  • ·        দ্বিতীয় শর্ত হলো, তাকে কৃত গুনাহের জন্যে অনুতপ্ত/লজ্জিত হতে হবে।
  • ·        তৃতীয় শর্ত হলো, পুনরায় গুনাহ না করার ব্যাপারে তাকে দৃঢ় সংকল্প/প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করতে হবে।

এই তিনটি শর্তের মধ্যে একটিও যদি অপূর্ণ থাকে, তাহলে তওবা কখনো শুদ্ধ হবে না। কিন্তু গুনাহ এর কাজটি যদি কোনো ব্যক্তির সাথে সম্পৃক্ত হয়, তবে সেক্ষেত্রে ঐ তিনটি শর্তের সাথে আরো একটি শর্ত যুক্ত হবে। আর এই চতুর্থ শর্তটি হলো ঐ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে হকদার ব্যক্তির হক আদায় করতে হবে। কারাে কাছ থেকে যদি কেউ অন্যায়ভাবে ধন-মাল বা বিষয়-সম্পত্তি ছিনিয়ে নিয়ে থাকে তবে তা ফেরত দিতে হবে। অনুরূপভাবে কারাে প্রতি মিথ্যা অপবাদ আরোপ করা হলে তার জন্যে অপরাধীকে নির্দিষ্ট শাস্তি (হ) ভোগ করতে হবে অথবা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে। কারাে অসাক্ষাতে গীবত (বা নিন্দাবাদ) করা হলে সেজন্যেও ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে।

 

মোটকথা, সমস্ত গুনাহর কাজেই তওবা করা আবশ্যক। যদি কতিপয় গুনাহর ব্যাপারে তওবা করা হয়, তবে আহলে সুন্নাতের দৃষ্টিতে তা শুদ্ধ বলে বিবেচিত হবে এবং অবশিষ্ট গুনাহর ব্যাপারে তওবা করা তার জিম্মায় থেকে যাবে। আল্লাহর কিতাব, রাসূলের সুন্নাহ ও ইজমায়ে উমত তওবা ওয়াজিব হওয়ার ব্যাপারে সাক্ষ্য প্রদান করে। ইবনে মাজাহ্ রা: মজবুত সনদের সাথে বর্ণনা করেন যে, যদি তোমরা গুনাহ্ কর। আর তোমাদের গুনার-পাহাড় আসমান পর্যন্ত পৌঁছে যায়, তারপরও যদি তোমারা সঠিক ভাবে ছাচ্ছা দিলে তাওবাহ্ কর তাহলে আল্লাহ তোমাদের তাওবাহ্ কবূল করে নিবেন।

তিবরানী শরীফে মজবুত সনদের সাথে বর্ণিত আছে: যে জান্নাতের আটটি দরওয়াজাহ্ আছে তন্মধ্যে সাতটি বন্ধ  আর একটি তাওবার দরওয়াজাহ এটি  খোলা আছে।  কিয়ামতের পূর্বে পশ্চিম দিগন্ত থেকে  ‍সূর্য উদয় হওয়ার আগ পর্যন্ত এই তাওবার দরওয়াজাহ্ খোলা থাকবে।  হাকিম এর বর্ণনায় আছে যাহাকে তিনি ছহি বলেছেন, মানুষের শুভাগ্য এই যে “তাদের আয়ু দীর্ঘ, (এনাবত ইলাল্লাহ্) আল্লাহর দিকে ধাবিত হওয়ার এবং আল্লাহর দাসত্ব কারার সুযোগ আল্লাহ তা’য়ালা তাদেরকে দান করেছেন।”

আরো বর্ণিত আছে  کُلُّ بَنِیْ آدَم خَطَّاءٌ وَ خَیْرُ الْخَطَّائینَ التّوّابین –  “সমস্ত বনি আদম পাপী আর সর্বোত্তম পাপী ঐ ব্যাক্তি যে পাপ করার পর অনুতপ্ত ও লজ্জিত হয়ে তাওবাহ করে”) অন্য এক হাদীসে আছে: التَّائِبُ مِنَ الذَّنْبِ کَمَنْ لّا ذَنْبَ لَہٌ তাওবাহ্ কারী ব্যাক্তি এমন যার কনো গুনাহ্ নাই।

শায়খাইন বর্ণনা করেছেন এক বান্দাহ গুনাহ্ করেছেন অতঃপর আল্লাহ তা’য়ালাকে বললেন হে রব ! আমিতো পাপ করেছি আমাকে ক্ষমা করেদিন। তখন আল্লাহ্ তা’য়ালা বলেন আমার বান্দার জানা আছে যে তাহার একজন মালিক আছে যিনি একমাত্র পাপ মার্জনা কারী, যিনি পাপের জন্য পাকড়াও করবেন। অতঃপর ক্ষমা করে দিলেন। বর্ণিত আছে যখন একজন মুমিন গুনাহ্ করে তখন তাঁর অন্তরে একটি কালো দাগ পড়ে যদি সে তাওবাহ্ করে গুনাহ থেকে ফিরে এসে ক্ষমা চায় তাহলে ঐ কালো দাগটি পরিষ্কার হয়ে যাবে। এবং যদি সে গুনাহ্ করতেই থাকে তাহলে তাঁর অন্তর কালোই হতে থাকবে। যাহা সম্পর্কে মহান আল্লাহ্ তা’য়ালা পবিত্র কুরআন মাজীদে বলেছেন –

  کَلَّا بَلْ رَانَ عَلٰی قُلُوْبِھِمْ مَاکَانُوْا یَکْسِبُوْنَ

কখনো না , বরং তাদের অন্তরে ঐ জিনিসে জং বেঁধে দিয়েছে যাহা তাহারা কামাই করিত।এই জং বাড়তে বাড়তে পুরা অন্তরকে ঘিরেফেলে। ফলে আর ঐ অন্তরে দ্বিনী আমল করতে মজা লাগেনা, দ্বিনী কথা ভালো লাগেনা।  গুনাহ্ করতেই মজা লাগে  মহান আল্লাহ তা’য়ালা বলেন:-

قَالَ اللهُ تَعَالٰى : وَتُوْبُوْا اِلَى اللهِ جَمِيْعًا اَيُّهَا الْمُؤْمِنُوْنَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ

হে ঈমানদারগণ! তোমরা সবাই আল্লাহর নিকট তওবা কর; তাহলে তোমরা কল্যাণ লাভ করবে। (সূরা নূরঃ৩১ আয়াত)

قَالَ للہُ تَعَالٰی :  اِسْتَغْفِرُوْ ا رَبَّکُمْ ثُمَّ تُوْبُوْا اِلَیْہِ

মহান আল্লাহ আরো বলেন:- তোমরা আপন প্রভুর নিকট ক্ষমা চাও, অতঃপর তার কাছে তওবা কর। (সূরা হুদ : ৩১ আয়াত)

وَقَالَ اللهُ تَعَالٰى : يٰاَيُّهَا الَّذِيْنَ أٰمَنُوْا تُوْبُوْا إِلَى اللهِ تَوْبَةً نَّصُوْحًا

মহান আল্লাহ আরো বলেন : হে ঈমানদার। তোমরা আল্লাহর কাছে খাটি মনে তওবা (তওবাতুন নাসূহ) কর।  (সূরা তাহরীম ৮ আয়াত)

 

 وَعَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةّ رَضِيَ اللہُ تعالٰی قَالَ سَمِعْتُ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ يَقُوْلُ وَاللهِ إِنِّيْ لَأَسْتَغْفِرُ اللهَ وَاَتُوْبُ اِلَيْهِ فِيْ الْيَوْمِ أَكْثَرِ مِنْ سِبْعِيْنَ مَرَّةً – رواه البخاری.

হযরত আবু হুরাইরা (রা) বর্ণনা করেন, আমি রাসূলে আকরামকে বলতে শুনেছি। আল্লাহর কসম! আমি একদিনে সত্তর বারের চেয়েও বেশি তওবা করি এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই। (বুখারী)।

وَعَنِ الْأَغَرِّ بْنِ يَسَارٍالْمُزَنِّی رض قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ یٰاَیُّھَا النَّاسُ تُوْبُوْا اِلَی اللّٰہِ  وَاسْتَغْفِرُوْهُ فَاِنِّیْ اَتُوْبُ فِيْ الْيَوْمِ مِائَةُ مَرَّةٍ – رواه مسلم

হযরত আগার ইবনে ইয়াসার মুযান্নী (রা) বর্ণনা করেন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ হে লোক সকল! তোমরা আল্লাহর কাছে তওবা কর এবং (গুনাহর জন্যে) তার কাছে ক্ষমা চাও। আমি প্রত্যহ একশতবার তওবা করি। (মুসলিম

وَعَنْ أَبِيْ حَمْزَةّ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ الْأَنْصَارِيِّ خَادِمِ رَسُوْلِ اللهِ ﷺ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ  اَللهُ أَفْرَحُ بِتَوْبَةِ عَبْدِهِ مِنْ أَحَدِكُمْ سَقَطَ عَلٰى بَعِيْرِه وَقَدْ أَضَلَّهٗ فِيْ أَرْضِ فَلَاةٍ – متفق عليه . وَفِيْ رِوَايَةٍ الْمُسْلِمِ : اَللهُ أَشَدُّ فَرْحًا بِتَوْبَةِ عَبْدِه حِيْنَ يَتُوْبُ إِلَيْهِ مِنْ أَحَدِكُمْ كَانَ عَلٰى رَاحِلَتِه بِاَرْضِ فَلَاةٍ فَانْفَلَتَتْ مِنْهُ وَعَلَيْهَا طَعَامُهٗ وَشَرَابُهُ فَاَیِسَ مِنْهَا فَاَتٰی شَجَرَةً فَاضْطَجَعَ فِي ظِلِّهَا وَقّدْ أَيِسَ مِنْ رَاحِلَتِه فَبَيْنَمَا هُوَ کَذَلِكَ إِذْ هُوَ بِهَا قَائِمَۃً عِنْدَهٗ فَاَخَذَ بِخِطَامِهَا ثُمَّ قَالَ مِنْ شِدَّاةِ الْفَرْحِ : اَللّٰهُمَّ أَنْتَ عَبْدِيْ وَأَنَا رَبُّكَ أَخْطَأَ مِنْ شِدَّةِ الْفَرْحِ .

রাসূলে আকরামসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খাদেম হযরত আবু হামযা আনাস ইবনে মালিক (রা) বলেন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহ তাঁর বান্দার তওবায় সেই ব্যক্তির চেয়েও বেশি খুশী হন, যার উট গভীর মরুভূমিতে হারিয়ে যাওয়ার পর আবার সে তা ফিরে পায়। (বুখারী ও মুসলিম) মুসলিমের অন্য এক বর্ণনায় আছে  আল্লাহ্ তাঁর বান্দার তওবায় সেই ব্যক্তির চেয়েও বেশি খুশী হন, যার খাবার ও পানীয় সামগ্রী নিয়ে সওয়ারী উটটি হঠাৎ গভীর মরুভূমিতে হারিয়ে গেল । অনেক খোঁজাখুঁজির পর হতাশ হয়ে লোকটি একটি গাছের ছায়ায় শুয়ে পড়ল। এরূপ অবস্থায় হঠাৎ সে উটটিকে নিজের কাছে দাঁড়ানাে দেখিতে পেল। সে উটের লাগাম ধরে আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে বলতে লাগল  হে আল্লাহ! তুমি আমার বান্দাহ! আর আমি তোমার প্রভু! সে আনন্দের আতিশয্যেই এ ধরনের। ভুল করে বসল।

 👉 তাবলিগ জামাতের ছয় উসূল 👈

 وَعَنْ أَبِيْ مُوْسٰى عَبْدِ اللهِ بْنِ قَیْسٍ الْأَشْعَرِيِّ رض عَنِ النَّبِيِّ ﷺ قَالَ إِنَّ اللهَ تَعَالٰى يَبْسُطُ يَدَهٗ بِاللَّيْلِ لِتُوْبَ مُسِيْءُ النَّهَارِ وَيَبْسُطُ يَدَهُ بِالنَّهَارِ لِيَتُوْبَ مُسِيْءُ اللَّيْلِ حَتّٰى تَطْلُعَ الشَّمْسُ مِنْ مَّغْرِبِهَا – رواه مسلم .

 

হযরত আবু মূসা আশআরী (রা) রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, পশ্চিম দিক থেকে সূর্যোদয় না হওয়া পর্যন্ত (অর্থাৎ কিয়ামত না আসা পর্যন্ত) মহান আল্লাহ প্রতি রাতে তাঁর ক্ষমার হাত প্রসারিত করতে থাকেন, যাতে করে দিনের গুনাহগার লোকেরা তওবা করে নিতে পারে। আর তিনি দিনের বেলা তাঁর ক্ষমার হাত প্রসারিত করে থাকেন, যাতে করে রাতের গুনাহগার লোকেরা তওবা করে নিতে পারে।

وَعَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ رض قَالَ : قَالَ رَسُوْلُ اللہِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مؐنْ تَابَ قَبْلَ أَنْ تَطْلُعَ الشَّمْسُ مِنْ مَّغْرِبِهَا تَابَ اللهُ عَلَيْهِ – رواه مسلم

হযরত আবু হুরাইরা (রা) বর্ণনা করেন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: যে ব্যক্তি পশ্চিম দিক থেকে সূর্যোদয়ের পূর্বে তওবা করবে, আল্লাহ তার তওবা কবুল করবেন। (মুসলিম)

 

وَعَنْ أَبِيْ عَبْدِ الرَّحْمٰنِ عَبْدِ اللهِ بْنِ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ رض عَنِ النَّبِيِّ ﷺ قَالَ اِنَّ اللہَ عَزَّ وَ جَلَّ يَقْبَلُ تَوْبَةً الْعَبْدِ مَا لَمْ  يُغَرْغِرْ – رواه الترمذي  – وَقَالَ حَدِيْثُ حَسَنٌ

 

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) বর্ণনা করেন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : মহিমান্বিত আল্লাহ মৃত্যুর নিদর্শন প্রকাশের পূর্ব পর্যন্ত বান্দার তওবা কবুল করে থাকেন। ইমাম তিরমিযী হাদীসটি বর্ণনা করেছেন এবং একে হাসান হাদীস বলে আখ্যা দিয়েছেন।

 

সাহাবীদের তাওবাহ্ কবূলের ঘটনা

তিরমিযী শরীফের অন্য একটি বর্ণনায় উল্লেখ আছে: হযরত যির ইবনে হুবাইশ (রা) বর্ণনা করেন । একদা আমি মােজার ওপর মাসেহ করার বিষয়ে প্রশ্ন করার উদ্দেশ্যে সাফওয়ান ইবনে আসলাম (রা)-এর কাছে উপস্থিত হলাম। তিনি আমার আসার উদ্দেশ্য সম্পর্কে প্রশ্ন করলে আমি বললাম, জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্যে এসেছি। তিনি বললেন : ফেরেশতারা জ্ঞান অন্বেষণকারীর জ্ঞান অন্বেষণে সন্তুষ্ট হয়ে তাদের ডানা তার জন্যে বিছিয়ে দেন। আমি বললাম, মলমূত্র ত্যাগের পর মােজার ওপর মাসেহ করার ব্যাপারে আমার মনে প্রশ্ন জেগেছে। আপনি রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একজন সাহাবী। এ কারণে আমি আপনার কাছে জানতে এসেছি যে আপনি এ ব্যাপারে তার কাছ থেকে কিছু শুনেছেন কিনা ? তিনি বললেন হাঁ; আমরা যখন সফরে থাকতাম তখন রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে তিনদিন তিনরাত অবধি জানাবাত (গােসল ফরয হওয়ার মতো নাপাক অবস্থা) ছাড়া পা থেকে মােজা খুলতে বারণ করেছেন। অর্থাৎ মলমূত্র ত্যাগ ও দ্রিার পর অযু করতে গিয়ে মােজা খুলতে হবে না। (অর্থাৎ পা ধােয়ার প্রয়োজন হবে না, শুধু মাসেহ করলেই চলবে।)

 

আমি জিজ্ঞেস করলাম, ভালোবাসা সম্পর্কে আপনি রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কিছু বলতে শুনেছেন কি? তিনি জবাবে বললেন  জ্বি হাঁ, আমরা এক সফরে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে ছিলাম। আমরা তার খুব কাছাকাছি  থাকাকালে একদিন হঠাৎ এক গ্রাম্য লোক (বেদুঈন) এসে খুব চড়া গলায় ‘হে মুহাম্মদবলে তাকে ডাক দিল। রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও একই রূপ জোরালো কণ্ঠে সাড়া দিয়ে বললেন এস, বসাে।আমি লোকটিকে বললাম! তোমার জন্যে আমার দুঃখ হয়। তুমি রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মজলিসে এসে চড়া গলায় আওয়াজ করছ; অথচ তোমাকে এরূপ করতে নিষেধ করা হয়েছে। তুমি গলার স্বর নিচু করাে। লোকটি বলল  ‘আল্লাহর কসম! আমি গলার স্বর নিচু করবাে না।এরপর সে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে প্রশ্ন করল  এক ব্যক্তি কোন সম্প্রদায়কে ভালোবাসে, অথচ সে এখনাে তাদের সাথে সাক্ষাতের অবকাশ পায়নি। এ ব্যাপারে আপনার অভিমত কি? রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন  (দুনিয়ায়) যে ব্যক্তি যাকে ভালোবাসে, কিয়ামতের দিন সে তারই সাথে থাকবে। এরপর তিনি কথা বলতে বলতে এক পর্যায়ে পশ্চিম দিকের একটি দরজার কথা বললেন, যার প্রস্থ পায়ে হেটে গেলে কিংবা যানবাহনে গেলে চল্লিশ থেকে সত্তর বছর। সুফিয়ান সাওরী নামক একজন হাদীস বর্ণনাকারী

 

বলেন  আল্লাহ তাআলা যেদিন আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন, সেই দিন থেকে তিনি এই দরজাটি তওবার জন্যে খােলা রেখেছেন। আর পশ্চিম দিক থেকে সূর্যোদয় না হওয়া পর্যন্ত এটি বন্ধ করা হবে না। ইমাম তিরমিযী এবং অন্যরা এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। খোদ ইমাম তিরমিযী একে সহীহ ও হাসান হাদীস রূপে উল্লেখ করেছেন।

বুখারী ও মুসলিম শরীফে আরো একটি হাদীস পাওয়া যায় এক ব্যক্তি নিরানব্বইটি লোক হত্যা করে

হযরত আবু সাঈদ ইবনে মালিক ইবনে সিনান আল খুদরী (রা) বর্ণনা করেন: রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : তোমাদের পূর্বেকার যুগে এক ব্যক্তি নিরানব্বইটি লোক হত্যা করে দুনিয়ার শ্রেষ্ঠতম আলেমের সন্ধানে বের হলো। তাকে একজন সংসারত্যাগী খ্রীস্টান দরবেশের কথা জানিয়ে দেয়া হলো। সে ঐ দরবেশের কাছে গিয়ে বললো ? আমি নিরানব্বইটি লোক হত্যা করেছি।এখন আমার জন্যে তওবার কোন সুযােগ আছে কি ? দরবেশ বললো  ‘নেই। তখন লোকটি দরবেশকেও হত্যা করে একশত সংখ্যা পূর্ণ করল। এরপর আবার সে দুনিয়ার শ্রেষ্ঠতম আলেমের সন্ধান জানতে চাইলে তাকে একজন আলেমের সন্ধান জানিয়ে দেয়া হলো। লোকটি তার কাছে গিয়ে বললো  সে একশাে লোককে খুন করেছে। এখন তার জন্যে তওবার কোন সুযােগ আছে কিনা ? আলেম বললেন : হাঁ, তওবার সুযােগ আছে। তওবা কবুলিয়তের পথে কে প্রতিবন্ধক হতে পারে ? তুমি অমুক স্থানে চলে যাও। সেখানে কিছু লোক আল্লাহর বান্দেগীতে লিপ্ত রয়েছে। তুমিও তাদের সঙ্গে আল্লাহর
বান্দেগীতে লিপ্ত হও এবং তোমার নিজ দেশে কখনো ফিরে যেওনা। কেননা
, সেটা খুব খারাপ জায়গা।লোকটি নির্দেশিত স্থানের দিকে চলতে লাগল । অর্ধেক পথ চলার পর তার মৃত্যুর সময় এসে পড়ল। এবার তাকে নিয়ে রহমত ও আযাবের ফেরেশতাদের মধ্যে বিতর্ক দেখাদিল।

রহমত ও আযাবের ফেরেশতাদের মধ্যে বিতর্ক: রহমতের ফেরেশতাদের বক্তব্য ছিল, এ লোকটি তওবা করে আল্লাহর দিকে ফিরে এসেছে। পক্ষান্তরে আযাবের ফেরেশতারা বলতে লাগল  লোকটি তো কখনো কোন পুণ্যের কাজ করেনি। এমন সময় বিরােধ নিষ্পত্তির জন্যে মানুষের রূপ ধারণ করে একজন ফেরেশতা তাদের সামনে উপস্থিত হলো। তখন সবাই তাকে সালিশ হিসেবে মেনে নিল। সালিশরূপী ফেরেশতা বললঃ তোমরা উভয় দিকের জায়গা মেপে নাও। যে দিকটি যার কাছাকাছি হবে, সে দিকটি তারই বলে গণ্য হবে। সুতরাং জায়গা পরিমাপের পর যেদিকের উদ্দেশ্যে সে আসছিল, তাকে সে দিকটির কাছাকাছি পাওয়া গেল। এর ভিত্তিতে রহমতের ফেরেশতারা লোকটির প্রাণ কেড়ে নিলেন। (বুখারী ও মুসলিম)।

সহীহ বুখারীর অপর একটি বর্ণনায় বলা হয়েছে: ওই লোকটি সৎ লোকদের বসতির দিকে হামাঘুড়ি দিয়ে এক বিঘত পরিমাণ অগ্রসর হয়েছিল । এই কারণে তাকে ওই লোকদেরই অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বুখারীর অপর একটি বর্ণনায় আছে, আল্লাহ তাআলা একদিকের বসতিকে দূরে সরে যেতে এবং অপর দিকের বসতিকে কাছাকাছি হতে বলে উভয়ের মধ্যবর্তী জমি মাপতে ফেরেশতাদের আদেশ দিলেন। ফলে লোকেরা তাকে সৎ লোকদের জমির দিকে এক বিঘত পরিমাণ বেশি অগ্রবর্তী দেখতে পেল এবং তাকে মার্জনা করে দেয়া হলো। অপর এক বর্ণনায় বলা হয়েছে, লোকটি নিজের বুকের ওপর ভর করে হামাগুড়ি দিয়ে অসৎ লোকদের জমি থেকে দূরে সরে গেল। (ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।)

তাবুক যুদ্ধের একটি ঘটনা:

হযরত কাব ইবনে মালিকের পুত্র আবদুল্লাহ বর্ণনা করেন স্বীয় পিতা কাব ইবনে মালিক (রা) অন্ধ হয়ে যাওয়ার পর তিনি (আবদুল্লাহ) তাঁর পরিচালক ছিলেন। তিনি তাবুক যুদ্ধে তার পিতার অংশগ্রহণ না করার কাহিনী বর্ণনা করে বলেন আমি তাবুক যুদ্ধে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে না গিয়ে পিছনে থেকে যাবার ব্যাপারে কাব ইবনে মালিক (রা)-এর বক্তব্য শুনেছি। তিনি (কা’ব) বলেনঃ একমাত্র তাবুক যুদ্ধ ছাড়া অন্য কোন যুদ্ধে আমি রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বিছিন্ন ছিলাম না। অবশ্য বদরের যুদ্ধ থেকেও আমি দূরে থেকে গিয়েছিলাম। কিন্তু
এই যুদ্ধে যারা যােগদান করেননি
, তাদের কাউকে সাজা দেয়া হয়নি। তখন রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার সঙ্গী মুসলমানরা কুরাইশদের একটি ব্যবসায়ী কাফেলা থেকে ধন-মাল ছিনিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে রওয়ানা করেছিলেন। এক পর্যায়ে আল্লাহ তাআলা (দৃশ্যত) অসময়ে মুসলমানদেরকে তাদের শত্রুদের সাথে যুদ্ধের মুখােমুখি করে দিলেন। আমরা আকাবার রাতে যখন ইসলামের ওপর অবিচল থাকার দৃপ্ত শপথ নিয়েছিলাম, তখন আমি রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গেই ছিলাম। যদিও বদরের যুদ্ধ লোকদের মধ্যে বেশি স্মরণীয় ঘটনা, তবু আমি আকাবায় উপস্থিতির পরিবর্তে বদরের উপস্থিতিকে অগ্রাধিকার দেয়া পছন্দ করিনা।

তাবুক যুদ্ধে আমারা রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে না যাবার কারণটা হচ্ছে এই যে, এই যুদ্ধের সময় আমি যতটা ধনবান ও শক্তিশালী ছিলাম, ততটা আর কোনো সময় ছিলাম না। আল্লাহর কসম! এ যুদ্ধের সময় আমার দু’টি উট ছিল; কিন্তু এর পূর্বে আর কখনো আমার একাধিক উট ছিল না। রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোথাও যুদ্ধে  যাওয়ার ইচ্ছা পােষণ করলে অন্য জায়গার কথা বলে প্রকৃত গন্তব্য স্থানের কথা গােপন রাখতেন। তিনি রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] অত্যধিক গরমের সময় তাবুক যুদ্ধে গমনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। সফরটা ছিল দীর্ঘ পথের; অঞ্চলটা ছিল খাদ্য ও পানিশূন্য। তদুপরি, শত্রুসেনার সংখ্যাও ছিল অনেক বেশি। এসব কারণে তিনি মুসলমানদের কাছে এই যুদ্ধের কথা খোলাখলি ব্যক্ত করলেন, যাতে করে সবাই যুদ্ধের। জন্যে সঠিকভাবে প্রস্তুতি নিতে পারেন। তিনি সাহাবীদের তার ইচ্ছার কথা খোলাখলি জানিয়ে দিলেন। অনেক মুসলিম যোদ্ধা এই যুদ্ধে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামেরসঙ্গী হলেন।

 তখনকার দিনে লোকদের নাম তালিকাভুক্ত করার জন্যে কোনো নির্দিষ্ট রেজিষ্ট্রি বই ছিল না।হযরত কাব (রা) বলেন ? তখনকার দিনে যে ব্যক্তি যুদ্ধে (জিহাদে অংশগ্রহণ না করে লুকিয়ে থাকতে চাইত, সে নিশ্চিতরূপে মনে করত যে, তার সম্পর্কে অহী নাযিল না হওয়া পর্যন্ত তার অবস্থাটা গােপনই থাকবে। রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন আলােচ্য যুদ্ধের জন্যে মদীনা থেকে রওয়ানা করেন তখন গাছের ফল (খেজুর) পেকে গিয়েছিল এবং গাছ-গাছালির ছায়াও বেশ আরামদায়ক হয়ে উঠেছিল। আমি এসবের ব্যাপারে খুবই আগ্রহী ছিলাম। যা হোক, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর সাহাবীগণ যথারীতি যুদ্ধ প্রস্তুতি সম্পন্ন করলেন। আমিও তার সঙ্গে যুদ্ধে যাওয়ার জন্যে প্রস্তুতি গ্রহণের লক্ষ্যে সকাল বেলা যেতাম বটে; কিন্তু কোনো কাজ না করেই বাড়ি ফিরে আসতাম এবং মনে মনে ভাবতাম যে, আমি ইচ্ছা করলেই এ কাজটি সম্পন্ন করতে পারব। 

এভাবে টালবাহানা করতে করতে অনেক দিন কেটে গেল। এমনকি, লোকেরা যুদ্ধে যাবার জন্যে সব রকম প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ফেলল। অবশেষে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবী যযাদ্ধাদের নিয়ে অতি প্রত্যুষে তাবুকের উদ্দেশে যাত্রা করলেন। কিন্তু আমি যুদ্ধে যাওয়ার জন্যে কোনো প্রস্তুতিই গ্রহণ করিনি। তাই আমি প্রস্তুতি নিতে গেলাম। কিন্তু পরদিনও আমি কিছুই করলাম না। এভাবে কিছুদিন আমার এই টালবাহানা চলতে থাকল। অন্য দিকে মুসলিম যোদ্ধারা খুব দ্রুত এগিয়ে গেলেন এবং যুদ্ধও একেবারে কাছাকাছি এসে পড়ল।

আমি তখন মনে মনে ভাবলাম, যে কোন মুহূর্তে রওয়ানা হয়ে গিয়ে ওদেরকে ধরে ফেলব। আহা! আমি যদি তা করতে পারতাম! কিন্তু তা আর আমার ভাগ্যেই জুটলনা। রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রওয়ানা হয়ে যাবার পর আমি রােজকার মতো মদীনার লোকদের মধ্যে চলাফেরা করতে লাগলাম। তখন যাদেরকে মুনাফিক বলে আখ্যায়িত করা হতো এবং যাদেরকে আল্লাহ দুর্বল ও অক্ষম বলে গণ্য করেছিলেন, সে ধরনের লোক ছাড়া আর কাউকে আমার মতো অবস্থায় দেখতে পেতাম না। | তাবুক যাবার পথে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার কথা মনে করেননি। সেখানে পৌঁছেই তিনি লোকদের জিজ্ঞেস করলেন, কাব ইবনে মালিকের কি হয়েছে ? বনী সালেমার এক ব্যক্তি বললেন : হে আল্লাহর রাসূল! তাকে তার দুই চাদর এবং শরীরের দুই পার্শ্বদেশের প্রতি নজর আটকে রেখেছে। (অর্থাৎ সে পােশাক-আশাক ও শরীর চর্চায় ব্যস্ত থাকার দরুন জিহাদে আসতে পারেনি) এ কথায় হযরত মুয়ায ইবনে জাবাল (রা) চমকে উঠে বললেন তুমি যা বলেছ, তা একদম ভুল কথা। আল্লাহর কসম হে আল্লাহর রাসূল! আমরা তো তার সম্পর্কে ভাল ছাড়া খারাপ কিছুই জানি না। এ কথায় রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চুপ রইলেন। ঠিক এ সময় তিনি সাদা পোশাকধারী এক ব্যক্তিকে মরুভূমির ভেতর দিয়ে এগিয়ে আসতে দেখলেন। তিনি বললেন ?

সে তো আবু খায়সামা! লোকটি কাছে আসতেই বােঝা গেল, তিনি সত্যিই আবু খায়সামা আনসারী। আর আবু খায়সামা হলেন সেই ব্যক্তি, যাকে মুনাফিকরা ঠাট্টা করেছিল এক সা’ পরিমাণ খেজুর। সাদকা হিসেবে দান করেছিলেন বলে । হযরত কাব বলেন  আমি যখন তাবুক থেকে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দেশে ফিরে আসার সংবাদ পেলাম, তখন খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। আর তাই মিথ্যা অজুহাত খাড়া করার বিষয় ভাবতে লাগলাম। বারবার আমার মনে প্রশ্ন জাগল, এখন কোন্ কৌশল করলে আমি আমাকে রাসূলে আকরাম  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অসন্তোষ থেকে রক্ষা পাবো ? আমার পরিবারে যারা বুদ্ধিমান ছিল, আমি তাদের সাহায্য চাইলাম। এরপর যখন রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শীঘ্রই ফিরে আসছেন বলে জানতে পারলাম, তখন  আমার মন থেকে সব আজেবাজে চিন্তা দূর হয়ে গেল। আমি স্পষ্টত বুঝতে পারলাম যে, অস্পষ্ট বা দ্ব্যর্থবােধক কথা বলে আমি রেহাই পাবনা। তাই সব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে আমি সত্য কথা বলারই দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করলাম। পরদিন সকালে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় ফিরে এলেন। সাধারণত তিনি সফর থেকে ফিরে প্রথমে মসজিদে গিয়ে দুরাকাআত নামায আদায় করতেন, তারপর লোকদের মধ্যে আসন গ্রহণ করতেন। এই নিয়ম অনুসারে তিনি যখন মসজিদে বসলেন, তখন যারা তাবুক যুদ্ধে না গিয়ে মদীনায় অবস্থান করছিল তারা কসম খেয়ে খেয়ে ওযর পেশ করতে লাগল। এরূপ লোকের সংখ্যা ছিল আশি জনের মতো। রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের প্রকাশ্য ওযর গ্রহণ করলেন। তাদের থেকে আনুগত্যের শপথ (বাইয়াত) গ্রহণ করলেন এবং তাদের গুনাহর জন্যে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে তাদের গােপন অবস্থা আল্লাহর কাছে ছেড়ে দিলেন। এরপর আমি সামনে উপস্থিত হয়ে যখন সালাম করলাম, তিনি মুচকি হাসি হাসলেন বটে, কিন্তু সে হাসিতে অসন্তুষ্টিই ঝরে পড়ছিল। এরপর তিনি আমায় কাছে ডাকলেন। আমি তার সামনে গিয়ে বসলাম। তিনি জিজ্ঞেস করলেন ও বলল, তোমার কি হয়েছিল?
তুমি কি কারণে পিছনে থেকে গিয়েছিলে? তুমি কি তোমার যানবাহন সংগ্রহ করতে পারনি? আমি (কা’ব) নিবেদন করলামঃ হে আল্লাহর রসূল! আমি যদি আপনি ছাড়া কোনো দুনিয়াদার লোকের সামনে বসা থাকতাম, তাহলে নিশ্চয়ই কোনো অজুহাত খাড়া করে তার অসন্তুষ্টি থেকে বাঁচার পথ খুঁজতে পারতাম।

যুক্তি বা অজুহাত খাড়া করার যােগ্যতাও আমার মধ্যে রয়েছে। কিন্তু আল্লাহর কসম! আমি খুব ভালো করেই জানি যে, আজ আমি আপনাকে মিথ্যা কথা বললে আপনি আমার প্রতি সন্তুষ্ট হবেন বটে, কিন্তু আল্লাহ নিশ্চয়ই আপনাকে আমার প্রতি অসন্তুষ্ট করে দেবেন। আর যদি আমি সত্য কথা বলার | দরুন আপনি আমার প্রতি অসন্তুষ্ট হনও, তবু আমি আল্লাহর নিকট শুভ ফলাফলের আশা রাখি। আল্লাহর কসম! আমার কোনো ওযর ছিল না। আল্লাহর কসম! আমি আজকের মতো আর কখনো এতটা মজবুত ও শক্তিশালী ছিলাম না। রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামর বললেন এই লোকটি সত্য কথাই বলেছে। আচ্ছা, তুমি চলে যাও আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমার ব্যাপারে কোনো ফয়সালা না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করাে। এরপর বনু সালেমার কতিপয় লোক আমার পিছনে পিছনে চলতে লাগল। তারা আমায় বলতে লাগল আল্লাহর কসম! এর আগে তুমি কোনো অপরাধ করেছ বলে আমাদের জানা নেই। তুমি কেন অন্যান্য লোেকদের মতো রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে কোনো ওযর পেশ করতে পারলেনা? তোমার গুনাহ মার্জনার জন্যে আল্লাহ্ মার্জনার কাছে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ক্ষমা চাওয়াইতো যথেষ্ট হতো। এরা আমায় এতটা ভৎসনা করতে লাগল যে, আমার রাসূলে আকরাম (স)-এর কাছে ফিরে গিয়ে নিজেকে মিথ্যাবাদী প্রমাণ করার ইচ্ছা হলো। এরপর আমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলাম, আমার মতো এরূপ ঘটনা আর কারাে ক্ষেত্রে ঘটেছে কি না? তারা বলল: হাঁ, আরো দু’জনের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার ঘটেছে। তুমি যা কিছু বলেছ, তারাও ঠিক সে রকমই বলেছে। আর তোমাকে যা বলা হয়েছে, তাদেরকেও সে কথাই বলা হয়েছে। হযরত কাব (রা) বলেন, আমি জিজ্ঞেস করলাম  সে দু’জন কারা? লোকেরা বলল, তারা হলেন মুরারা ইবনে রাবীআ। ‘আমেরী ও হিলাল ইবনে উমাইয়া ওয়াফেকী (রা)।

হযরত কাব (রা) বলেন লোকেরা আমায় যে দুই ব্যক্তির নাম বলল, তারা ছিলেন খুবই আদর্শবান ও সত্যৰ্মশীল; তারা বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। কাব (রা) আরো বলেন  লোকেরা ঐ দুজন সম্পর্কে খবর দিলে আমি আমার পূর্বেকার নীতির ওপর অবিচল থাকলাম। যারা পিছনে থেকে গিয়েছিল, তাদের মধ্য থেকে আমাদের তিন জনের সাথে কথা বলতে। রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লোকদেরকে বারণ করে দিলেন। এর ফলে আশপাশের সব লোক আমাদের থেকে দূরে সরে থাকতে লাগল । (অর্থাৎ আমাদের ব্যাপারে তাদের মনোভাব একেবারে বদলে গেল) এমনকি, আমার জন্যে দুনিয়ার চেহারাটাই একেবারে পাল্টে গেল। আমার চেনাজানা পৃথিবী হঠাৎ যেন অজানা ও অপরিচিত হয়ে গেল। এভাবে আমরা পঞ্চাশটি দিন অতিবাহিত করলাম। আমার দু’জন সঙ্গী নিজেদের ঘরেই অবরুদ্ধ হয়ে পড়লেন। তারা ঘরে বসে কেঁদে কেঁদে সময় কাটাতে লাগলেন। (কারণ তারা উভয়ে বয়ােবৃদ্ধ ছিলেন । কিন্তু আমি ছিলাম যুবক ও শক্তিমান। তাই আমি বাইরে গিয়ে সাধারণ মুসলমানদের সাথেই নামায পড়তাম এবং হাট-বাজারেও নির্দ্বিধায় চলাফেরা করতাম। কিন্তু অবাক হয়ে দেখতাম, কেউ আমার সাথে কথা বলছে না। নামাযের সময় রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দিষ্ট স্থানে বসলে আমি তাকে সালাম করতাম এবং এই ভেবে অপেক্ষা করতাম, দেখি তিনি সালামের জবাব দিতে ঠোট নাড়েন কিনা। মসজিদে আমি তার কাছাকাছি নামায পড়তাম এবং চুপিসারে লক্ষ্য রাখতাম, তিনি আমার দিকে তাকান কিনা।

আমি যখন নামাযে লিপ্ত থাকতাম তখন তিনি আমার দিকে তাকাতেন। কিন্তু আমি যখন তার দিকে তাকাতাম, তিনি আমার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিতেন। এভাবে গােটা মুসলিম সমাজের নির্লিপ্ততার দরুন আমার এ অবস্থা যখন দীর্ঘায়িত হলো, তখন একদিন আমি প্রতিবেশী আবু কাতাদার দেয়ালের ভেতরে ঢুকে তাঁকে সালাম দিলাম; কিন্তু আল্লাহর কসম সে আমার সালামের কোনো জবাব দিল না।অথচ সে ছিল আমার চাচাত ভাই এবং ঘনিষ্টতম বন্ধু। আমি তাকে বললাম  আবু কাতাদাহ! আমি তোমায় আল্লাহর কসম দিয়ে জিজ্ঞেস করছি, তুমি কি জাননা যে, আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালোবাসি? সে যথারীতি চু থাকল। আমি আবার তাকে কসম দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম। এবারও সে চুপ থাকল। আমি পুনরায় কসম দিলে সে কেবল এটুকু বলল, আল্লাহ ও তার রাসূলই ভাল জানেন। তার এ কথায় আমার চোখ দিয়ে দর দর বেগে অশ্রু বেরিয়ে এলাে। আমি দেয়াল ডিঙিয়ে ফিরে এলাম।

এরপর একদিন আমি মদীনার বাজারে ঘুরাফিরা করছিলাম। এমন সময় মদীনায় খাদ্যদ্রব্য বিক্রি করতে আগত এক সিরীয় কৃষক আমায় খুঁজতে লাগল। সে লোকদের কাছে এই মর্মে অনুরোধ করছিল যে, আমাকে কাব বিন মালিকের ঠিকানাটা একটু বলে দিন। এর জবাবে লোকেরা আমার দিকে ইঙ্গিত করল। সে আমার কাছে এসে আমায় গাসসানের বাদশাহর একটি চিঠি দিল। আমি চিঠিখানা আদ্যপান্ত পড়লাম। তাতে লেখা ছিল । আমি জানতে পারলাম যে, তোমার সাথী (রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তোমার ওপর জুলুম পীড়ন চালাচ্ছে। অথচ আল্লাহ তোমায় লাঞ্ছিত ও নির্যাতিত হবার জন্যে সৃষ্টি করেননি। কাজেই তুমি আমাদের কাছে চলে এস। আমরা তোমায় সর্বতোভাবে সাহায্য করব। আমি চিঠিখানা পড়ে বললাম, এটাও আমার জন্যে এক পরীক্ষা। আমি অবিলম্বে চিঠিখানা আগুনে পুড়িয়ে ফেললাম। এভাবে পঞ্চাশ দিনের মধ্যে চল্লিশ দিন অতিক্রান্ত হলো। এর মধ্যে আর কোনো অহী। নাযিল হলো না।

স্ত্রী থেকে আলাদা থাকার নির্দেশ

হঠাৎ একদিন রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এক বার্তাবাহক এসে আমায় জানাল, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে আমার স্ত্রী থেকে আলাদা থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। আমি জানতে চাইলাম, আমি কি তাকে তালাক দেব নাকি অন্য কিছু করব? বার্তাবাহক জানাল  না, তুমি শুধু তার থেকে আলাদা থাকবে, তার ঘনিষ্ঠ হবে না। (অর্থাৎ তার সাথে দৈহিক মিলন করবে না। আমার অন্য দুজন সঙ্গীকেও অনুরূপ বার্তা পাঠানো হলো। আমি স্ত্রীকে বললাম, তুমি অবিলম্বে পিত্রালয়ে চলে যাও এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কোনো ফয়সালা না আসা পর্যন্ত তাদের সাথেই থাকো। হেলাল ইবনে উমাইয়ার স্ত্রী রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে নিবেদন করলেন হে আল্লাহর রাসূল! হেলাল ইবনে উমাইয়া খুবই বৃদ্ধ মানুষ; তার দেখাশোনার জন্যে কোনো খাদেম নেই। আমি তার দেখাশোনা করলে আপনি কি অসন্তুষ্ট হবেন ? রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন  না, তবে সে যেন তোমার সাথে দৈহিক মিলনে রত না হয়। উমাইয়ার স্ত্রী বললেন আল্লাহর কসম! এ ব্যাপারে তার কোনো শক্তিই নেই। আল্লাহর কসম! আজ পর্যন্ত তার ব্যাপারে যা কিছু ঘটেছে তাতে সে অবিরাম কেঁদে চলেছে। (কাব বলেন) আমার পরিবারের অনেক সদস্য আমায় বলেন “তুমি রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছ থেকে তোমার স্ত্রীর সেবা (খেদমত) গ্রহণের ব্যাপারে অনুমতি নিতে পারতে। তিনি তো হেলাল ইবনে উমাইয়ার সেবা করার জন্যে তার স্ত্রীকে অনুমতি দিয়েছেন। আমি বললাম ও ‘আমি রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এ বিষয়ে কোনো অনুমতি চাইব না। কে জানে, এ বিষয়ে তাঁর কাছে অনুমতি চাইলে তিনি কি বলেন। তাছাড়া আমি হচ্ছি একজন যুবক। এভাবে আরো দশদিন অতিবাহিত করলাম। আমাদের সাথে কথা বলা নিষিদ্ধ ঘােষণার পর পুরাে পঞ্চাশ দিন অতিক্রান্ত হলো। একদিন ভােরে ফজরের নামায আদায় করে আমি আমার ঘরের ছাদে এমন অবস্থায় বসা ছিলাম, যে অবস্থার দরুন আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজীদে আমাদের সম্পর্কে বলেছেন  আমার মন ক্ষুদ্র হয়ে গেছে এবং ধরিত্রি প্রশস্ত হওয়া সত্ত্বেও আমার জন্যে তা সঙ্কীর্ণ হয়ে গেছে। একদিন আমি এরূপ অবস্থায় বসে আছি, এমন সময় হঠাৎ আমি সাল্আ পাহাড়ের ওপর থেকে এক ব্যক্তির (আবু বকর সিদ্দীক) চীৎকার শুনতে পেলাম। তিনি খুব চড়া গলায় বলতে লাগলেনঃ হে কাব তোমাকে মুবারকবাদ, তুমি সুসংবাদ, গ্রহণ কর। আমি এ কথা শােনামাত্র সিজদায় পড়ে গেলাম এবং বুঝতে পারলাম যে, আমাদের মুক্তির বার্তা এসেছে। আল্লাহ আমাদের তওবা কবুল করেছেন, এ সুসংবাদ রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফজরের নামায বাদ সমস্ত লোককে জানিয়ে দিলেন। এতে উৎসাহিত হয়ে লোকেরা আমাদের সুসংবাদ দিতে এল। অন্যদিকে কতিপয় লোক আমার দু’জন সঙ্গীকে সুসংবাদ দিতে গেল। অপর এক ব্যক্তি (যুবাইর ইবনে আওয়াম) ঘােড়ায় চেপে আমার দিকে ছুটে এল। আসলাম গােত্রের এক ব্যক্তি (হামযা ইবনে উমর আল-আসলামী) ছুটতে ছুটতে পাহাড়ের ওপর গিয়ে উঠল।

তার আওয়াজ ছিল ঘােড়ার চেয়ে বেশি দ্রুতগামী। যে ব্যক্তি আমায় সুসংবাদ দিচ্ছিল, তার আওয়ায শােনামাত্র আমি (আনন্দের আতিশয্যে) নিজের দুপ্রস্থ কাপড় খুলে তাকে পরিয়ে দিলাম। আল্লাহর কসম! সেদিন ঐ দু’প্রস্থ কাপড় ছাড়া আমার আর কোনো পােশাক ছিল না। তাই আমি আরো দুখানা কাপড় ধার করে নিলাম এবং তা পরেই রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের
উদ্দেশ্যে রওয়ানা করলাম।
পথিমধ্যে লোকেরা দলে দলে এসে আমার সাথে সাক্ষাত করে তওবা কবুলের জন্যে আমায় মুবারকবাদ জানাতে লাগল। তারা আমায় বলতে লাগল, আল্লাহ্ তোমার তওবা
কবুল করেছেন। বলে তোমাকে আন্তরিক মুবারকবাদ। শেষ পর্যন্ত আমি মসজিদে নববীতে) প্রবেশ করলাম। তখন রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখানে বসা ছিলেন
; লোকেরা ছিল তার চার দিক পরিবেষ্টন করে। হঠাৎ তাহা ইবনে উবায়দুল্লাহ (রা) খুব দ্রুত ছুটে এসে আমার সাথে সজোরে করমর্দন করে আমায় মুবারকবাদ জানালেন। আল্লাহর কসম! তাহা ছাড়া এভাবে আর কোনো মুহাজির উঠে আসেননি। (বর্ণনাকারী বলেনঃ) এ জন্যে হযরত কাব (রা) হযরত তালহা (রা)-এর এই ব্যবহার কোনোদিন ভুলেননি।
এছাড়া এভাবে আর কোনো মুহাজির উঠে আসেননি। (বর্ণনাকারী বলেনঃ) এ জন্যে হযরত কাব (রা) হযরত তালহা (রা)-এর এই ব্যবহার কোনোদিন ভুলেননি।

খােশ-খবর গ্রহণ

হযরত কাব (রা) বলেন আমি যখন রসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সালাম দিলাম, তখন তাঁর মুখমণ্ডল আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল। তিনি বললেন : তোমার জন্মদিন থেকে শুরু করে এ পর্যন্তকার সবচাইতে উত্তম দিনের খােশ-খবর গ্রহণ কর। আমি জানতে চাইলাম এ সুসংবাদ কি আপনার তরফ থেকে না আল্লাহর তরফ থেকে হে আল্লাহর রাসূল? তিনি বললেন না, আমার থেকে নয়, বরং মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে। বস্তুত রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কোন ব্যাপারে আনন্দিত হতেন, তার চেহারা যেন এক টুকরা চাদের ন্যায় উজ্জ্বল হয়ে উঠত। তার চেহারার এই পরিবর্তনটা আমরা বুঝতে পারতাম। এরপর আমি যখন তার সামনে বসলাম, তখন স্বতঃস্ফূর্তভাবে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমার তওবা কবুল হওয়ায় আমার সমস্ত ধন-মাল আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের জন্যে সাদকা করে দিতে চাই।রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন কিছু মাল তুমি নিজের জন্যে রেখে দাও; এটাই তোমার জন্যে উত্তম। আমি বললাম বেশ, তাহলে আমার খায়বরের অংশটা রেখে দিলাম। আমি আরো নিবেদন কলাম “হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহ আমায় সত্য কথা বলার দরুন রেহাই দিয়েছেন। কাজেই আমার তওবার
এও দাবি যে
, বাকী জীবনে আমি কেবল সত্য কথাই বলে যাব।

আল্লাহর কসম! আমি যখন এ কথাগুলাে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে বলেছিলাম, তখন থেকে সত্যের ব্যাপারে আল্লাহ অন্য কোনো মুসলিমকে আমার মতো এমন চমৎকারভাবে পরীক্ষা করেছেন বলে আমার জানা নেই। আল্লাহর কসম! তখন থেকে আজ পর্যন্ত আমি কোনো মিথ্যা বলার অভিপ্রায় করিনি। অবশিষ্ট জীবনেও আল্লাহ আমাকে মিথ্যার অভিশাপ থেকে রক্ষা করবেন বলে আশা পােষণ করি। তিনি বলেন, এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বিশেষ আয়াত নাযিল করেছেন। তাতে বলা হয়েছে : “নিশ্চয়ই আল্লাহ পয়গাম্বর, মুহাজির ও আনসারদের তওবা কবুল করেছেন। তিনি তাদের প্রতি দয়াশীল ও মেহেরবান। আর যে তিন জন পিছনে থেকে গিয়েছিল, তাদের তওবাও তিনি কবুল করেছেন। এমনকি শেষ অবধি এ দুনিয়া প্রশস্ত হওয়া সত্ত্বেও তাদের জন্যে সংকীর্ণ হয়ে গিয়েছিল আল্লাহকে ভয় করে চলাে এবং সত্যনিষ্ঠদের সঙ্গে থাকো। (সূরা তওবা ও ১১৭-১১৯ আয়াত)

হযরত কাব আরো বলেন আল্লাহর কসম! আল্লাহ যখন থেকে আমায় ইসলাম গ্রহণের তওফীক দিয়েছেন, তখন থেকে এ পর্যন্ত আমি রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট সত্য কথাই বলে আসছি এবং এটা আমার জন্যে আল্লাহর সবচাইতে বড় নিয়ামত। (আল্লাহর কাছে আমার প্রার্থনা) আমি যেন মিথ্যা কথা বলে ধ্বংসপ্রাপ্ত না হই, যেমন করে অন্যান্য মিথ্যাবাদীরা ধ্বংস হয়ে গেছে।

আল্লাহ অহী অবতরণের যুগে মিথ্যাচারীদের সবচাইতে বেশি নিন্দা করেছেন। সূরা তাওবায় তিনি বলেন  ‘তোমরা যখন তাদের কাছে ফিরে যাবে, তখন তারা আল্লাহর কসম খেয়ে তোমাদের সামনে ওযর পেশ করবে। যেন তোমরা তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না কর। যা হোক, তাদেরকে তুমি ছেড়েই দাও। তারা মূলত অপবিত্র আর (তাই) তাদের স্থান হবে জাহান্নাম। এটা হলো তাদের কৃতকর্মের ফসল। তারা তোমাদেরকে খুশী করার জন্যে তোমাদের নিকট হলফ করে মিথ্যা অজুহাত পেশ করবে। তোমরা তাতে ওদের প্রতি সন্তুষ্ট হলেও আল্লাহ কিছুতেই এহেন ফাসেকদের প্রতি সন্তুষ্ট হন না।‘ (সূরা তওবা ও ৯৫-৯৬) |

হযরত কাব আরো বলেন যারা রাসূলে আকরাম (স)-এর নিকট হলফ করে মিথ্যা অজুহাত পেশ করেছিল, তিনি তাদের অজুহাত গ্রহণ করে তাদের থেকে বাইয়াত নিয়েছিলেন এবং তাদের গুনাহ মার্জনার জন্যে দোআও করেছিলেন। কিন্তু আমাদের তিন জনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণটা পিছিয়ে দিলেন। অবশেষে মহান আল্লাহ বিষয়টির নিষ্পত্তি করে দিলেন। আল্লাহ যে বলেছেন, “আর যে তিনজন পেছনে থেকে গিয়েছিল’ এর অর্থ জিহাদ থেকে আমাদের পিছনে থাকা নয়; বরং এর অর্থ হলো, যারা মিথ্যা অজুহাত পেশ করেছিল এবং রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা কবুল করেছিলেন। আমাদের ব্যাপারটা তাদের পরে রাখা হয়েছিল।

ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। অপর এক বর্ণনায় বলা হয়েছে ? রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বৃহস্পতিবার তাবুক যুদ্ধের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করেন। কেননা,
তিনি বৃহস্পতিবার সফরে যাওয়া পছন্দ করতেন। অপর এক রেওয়ায়েতে বলা হয়েছে তিনি সাধারণত দিনের বেলা দুপুরের পূর্বে সফর থেকে ফিরতেন এবং সফর থেকে ফিরেই প্রথমে তিনি মসজিদে যেতেন। এরপর সেখানে দুরাকআত নামায পড়তেন এবং তারপর বসতেন।

ব্যভিচারি এক মহিলা সাহাবীয়ার ঘটনা: (ঘটনাটি মুসলিম শরীফে বর্ণিত আছে।)

হযরত ইমরান ইবনে হুসাইন আল-খুযাঈ (রা) বর্ণনা করেন, জুহাইনা গােত্রের জনৈক মহিলা ব্যভিচারের মাধ্যমে গর্ভবতী হয়ে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে নিবেদন করল : হে আল্লাহর রাসূল! আমি ব্যভিচারের (যিনার) অপরাধ করেছি; আমাকে এর শাস্তি দিন। রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার অভিভাবককে ডেকে বললেন এর সঙ্গে সদাচরণ করবে। এ সন্তান প্রসব করার পর আমার নিকট নিয়ে আসবে। লোকটি তা-ই করল। এরপর রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ব্যভিচারের শাস্তি প্রদানের নির্দেশ দিলেন।

তার শরীরের কাপড়-চোপড় ভালো করে বেঁধে দেয়া হলো এবং নির্দেশ মুতাবেক তাকে পাথর মেরে হত্যা করা হলো। রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার জানাযার নামাযও পড়ালেন। হযরত উমর (রা) তাঁকে বললেন হে আল্লাহর রাসূল! এ মেয়েটি তো ব্যভিচার (যিনা) করেছে। তবু আপনি এর জানাযার নামায পড়াচ্ছেন। রসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেলেন এ মেয়েটি এমন তওবা করেছে যে, তা চল্লিশ জন মদীনাবাসীর মধ্যে বন্টন করে দিলেও সবার জন্যে পর্যাপ্ত হয়ে যেত। যে মেয়েটি নিজের জীবনকে মহান আল্লাহর জন্যে স্বেচ্ছায় বিলিয়ে দিতে পারে, তার এহেন তওবার চেয়ে ভালো কোনো কাজ তোমার জানা আছে কি?
(মুসলিম)
রিয়াজুস সালেহীন 52 পৃ.

Thank you for reading the post.

1 thought on “তাওবার গুরুত্বপূর্ণ আলোচা | সাহাবীদের তাওবাহ্ কবূলের ঘটনা |”

  1. Pingback: তেত্রিশ (৩৩) আয়াতের ফযিলত ও আমল - Educational Tips & Tricks.

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top