আশুরা, আশুরার তাৎপর্য ও করনীয়।
মুহাররাম মাসের ১০ তারিখকে আশুরা বলা হয়।
আরবী বছর গণনায় মুহাররম মাস প্রথম। এটি নাম বাচক বিশেষ্য নয়, গুণবাচক বিশেষণ। সৃষ্টির শুরু থেকে এ মাসে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। মুহাররম সম্মানিত, মর্যাদাবান বিধায় একে বিশেষিত করা হয়। পরে আসল নাম সফর আউয়াল’ বাদ পড়ে যায় এবং মুহাররম তদস্থলে মাসের নামে পরিণত হয়।
আশুরা মানে শুধু কারবালা দিবস নয় ?
বছরের মহান ঐতিহাসিক দিবস আশুরা’ সমাগত। এ দিন মানবতাকে স্মরণ করিয়ে দেয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার কথা। এসব ঘটনায় রয়েছে ইতিহাসের জোয়ার-ভাটা ও উত্থানপতনে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা। আমাদের সমাজে অনেকের ধারনা, আশুরা মানেই কারবালা। আশুরাকে তারা কারবালার দিবস হিসেবে পালন করে। হায় হুসাইন, হায় হুসাইন’ বলে মাতম করে। রাস্তায় রাস্তায় র্যালী বের করে। অদ্ভুত মঞ্চ সজ্জা করে। রাতের গভীরে হঠাৎ ব্যান্ড পার্টির মাধ্যমে উৎপাত সৃষ্টি করে। মানুষকে করে ফেলে হতবিহ্বল ও আতঙ্কিত। এসব আজগুবী কাজ কারবার মানেই আশুরা নয়। আশুরা‘ দিবসে সংঘটিত বহু ঘটনার একটি হল কারবালার ট্রাজেডি এতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু কারবালার দুঃখবহ ঘটনাই একমাত্র আশুরা’নয়। কারণ ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায় মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর যুগেও ‘আশুরা পালিত হত। তখনও কিন্তু কারবালার ঘটনা সংঘটিত হয়নি। কাজেই কারবালার ঐতিহাসিক ঘটনার কারণে আশুরার মর্যাদা ও তাৎপর্য সৃষ্টি হয়নি। এ দিনটির তাৎপর্য পৃথিবীর সূচনা হতেই চলে আসছে। বরং আমরা বলতে পারি,কারবালার ঘটনা আশুরার দিনে সংঘটিত হওয়ায় এ ঘটনা অনেক বেশী তাৎপর্যপূর্ণ হয়েছে। আশুরার দিন রোযা রাখতে হবে। এটি গুরুত্বপূর্ণ নফল রোযা। তবে তার পূর্বে ও পরে আরেকটি রোযা সংযোগ করতে হবে। যাতে ইহুদীদের রোযা প্রথা থেকে মুসলমানদের আশুরা পালন ভিন্ন মাত্রা পায়। এ দিনে মাতম করা, হানা-হানি করা, কারবালার ঘটনাকে মঞ্চস্থ করা ইসলাম সম্মত যেমন নয়, তেমনি যুক্তি সঙ্গতও নয়। এ ঘটনা মঞ্চস্থ করলে আজকের মুসলিম উম্মাহর কি কল্যাণ ? কি উপকার ? বরং কারবালার শিক্ষা কি তা-ই সেমিনার, সেম্পোজিয়াম, সভা-মাহফিলের সর্বত্র উচ্চারিত হওয়া উচিৎ এবং সে অনুযায়ী আমাদের জীবনকে ঢেলে সাজানো প্রয়োজন।
আশুরার রোযা সম্পর্কে নিম্নের হাদীছ সমূহ দ্রষ্টব্য :
عن أبي هريرة قال : مر النبي صلى الله عليه وسلم بأناس من اليهود قد صاموا يوم عاشوراء، فقال : ما هذا من الصوم؟ قالواهذا اليوم الذي نجی الله موسى وبني إسرائيل من الغرق وغرق فيه فرعون وهذا يوم استوت فيه السفينة على الجودي فصامه نوح وموسی شکرالله تعالى فقال النبي صلى الله عليه وسلم : أنا أحق بموسى وأحق بصوم هذا اليوم فأمر أصحابه بالصوم –
হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, মহানবী (সাঃ) কিছু ইহুদীকে দেখলেন আশুরা দিবসে তারা রোযা পালন করেছে। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, এটি কিসের রোযা? তারা বলল, এ দিন আল্লাহ মূসা (আঃ) ও বনী ইস্রাইল সম্প্রদায়কে সমুদ্রে ডুবে মরার হাত হতে উদ্ধার করেছেন। ফেরাউনকে ডুবিয়ে মেরেছেন। আর এ দিন জুদি’ পর্বতে নূহের (আঃ) জাহাজ ভিড়েছিল। তাই নূহ ও মূসা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে এ দিনে রোযা পালন করেছিলেন। মহানবী (সাঃ) বললেন, আমি মূসার (আঃ) অনুসরনের বেশি উপযুক্ত এবং এ দিবসের রোযার বেশি হকদার। তিনি তাঁর সাহাবাদেরকে রোযা পালনের নির্দেশ দান করেন। (মসনদে আহমদ)
عن أبي سلمة الأكوع أنه قال: بعث رسول الله صلى الله عليه وسلم رجلا من أسلم يوم عاشوراء فأمره أن يوذن في الناس من كان لم يصم فليصم ومن كان أكل فليتم صيامه إلى الليل –
‘আসলাম‘ গোত্রে এক লোককে মহানবী (সাঃ) এ সংবাদ ঘোষনার দায়িত্ব দিয়ে আশুরার দিন প্রেরণ করলেন যে, “যারা আজ রোযা রাখেনি তারা যেন রোযা রেখে নেয়। আর যারা ইতোমধ্যে খাওয়া-দাওয়া করেছে তারা যেন রাত পর্যন্ত পানাহার হতে বিরত থাকে।” (মুসলিম)
عن ابن عباس قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم صوموا يوم عاشوراء وخالفوا فيه اليهود، صوموا قبله يوما أو بعده يوما.
“তোমরা আশুরার দিন রোযা রাখ এবং ইহুদীদের থেকে ব্যতিক্রম কর। আশুরার এক দিন পূর্বে বা একদিন পরেও রোযা রাখ।”
لَئِنْ بَقِيْتُ إِلٰى قَابِلٍ لَأَصُوْمَنَّ الْيَوْمَ التََّاسِعَ –
আমি আগামী বছর বেঁচে থাকলে নবম দিনেও রোযা রাখব। (মুসলিম, আবু দাউদ)
আশুরার দিন রোযা রাখার ফজিলত সম্পর্কে মহানবী (সাঃ) বলেন:
عن أبي قتادة قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم صِيَامُ عَاشُوْرَاءَ أَحْتَسِبُ عَلَى اللهِ أَنْ يُّكَفِّرَ السَّنَةَ الَّتِيْ قَبْلَهٗ – رَوَاہُ مُسْلِم –
আশুরার দিনের রোযার ব্যাপারে আমি আল্লাহর নিকট আশাবাদী যে, তিনি এক বছর পূর্বের গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন। (মসনদে আহমদ)
আশুরার ঐতিহাসিক ঘটনা সমূহ:
ঐতিহাসিক দিক দিয়ে এ দিনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। যেমন:-
1. এ দিনে আদম (আঃ) কে সৃষ্টি করা হয়।
2.ফেরেস্তাদের নির্দেশ দেয়া হয় আদম (আঃ) কে সিজদা করতে।
3.বেহেস্ত থেকে তাকে দুনিয়ায় প্রেরণ করা হয়।
4. এবং আরাফাতে আদম ও হাওয়ার মিলন হয়।
5. এদিনে নূহের প্লাবন হয় এবং এ দিনেই আবার তিনি প্লাবনের পরে নৌকা থেকে নেমে আসেন।
6. এ দিনে ইব্রাহীম (আঃ) নমরুদের আগুন থেকে মুক্তি পান।
7. এ দিনে ইউনুস (আঃ) মাছের পেট থেকে বেরিয়ে আসেন।
8. ৬০ হিজরী /৬৮০ খ্রীষ্টাব্দে এ দিনে ইরাকের ফোরাত নদীর তীরে কারবালা প্রান্তরে স্মরণকালের মানব ইতিহাসের নির্মমতম হৃদয়বিদারক ঘটনা সংঘটিত হয়।
9. রহমাতুল্লিল আলামীনের প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র, ফাতেমা দুলাল, চতুর্থ খলীফা হযরত আলী (রাঃ) – এর পুত্র ইমাম হুসাইন (রা:) সপরিবারে এদিন শাহাদাত প্রাপ্ত হন।
10. হযরত আইয়ুব আঃ দূরারোগ্য ব্যাধি থেকে সুস্থতা পেয়েছেন।
11. ঈসা আঃ কে উর্দাকাশে উঠিয়ে নিয়েছেন।
12. এই দিনে কিয়ামত সংঘটিত হবে। যদিও এবিষয়ে মতভিন্নতা রয়েছে।
13. দাউদ আঃ ত্বওবাহ কবূল হয়ে ছিল।
দামিশক অধিপতি ইয়াজিদের দুর্ধর্ষ সেনাবাহিনীর হাতে ফোরাতের কিনারে। নীতি ও আদর্শের জন্য, সত্য ও ন্যায়ের জন্য অকাতরে অবলীলাক্রমে প্রাণদানের এধরনের নজীর বিরল। অপ্রতিরোধ্য ও দুর্বার শক্তির মোকাবিলায় দুর্বলের প্রতিরোধের যে ইতিহাস সেদিন আশুরাতে কারবালার প্রান্তরে রচিত হয়েছে, তা কালজয়ী। কালানুক্রমে তা বিস্ময়করভাবে শিক্ষণীয় হয়ে রয়েছে মানবজাতির জন্য। তাই কবি বলেছেনঃ “ইসলাম
জিন্দা হোতা হায় কারবালাকে বাদ”।
আশুরার তাৎপর্য কেবল কারবালার ঘটনাতেই নিহিত নয়। যেহেতু কারবালার ঘটনা ঐতিহাসিক দিক দিয়ে সময়ের নিরিখে নিকটতর তাই এর আবেদন স্বাভাবিকভাবেই অধিক। মানব ইতিহাসের সূচনা লগ্ন থেকেই এই আশুরাতে সংঘটিত ঘটনাবলী মানবজাতির জন্য দিকনির্দেশনা হয়ে
রয়েছে।
Thank you for reading the post.