নূরানী শিক্ষার পদ্ধতি ও কৌশল
“টিস-কম্পিউটার” এর পক্ষ থেকে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের আজকের আলোচ্য বিষয়: নূরানী শিক্ষা পদ্ধতি ও এর ইতিহাস। ইসলামী শিক্ষার এই বিশেষ পদ্ধতিটি কীভাবে মুসলিম সমাজে অপরিহার্য হয়ে উঠেছে এবং এর পিছনের অনুপ্রেরণা ও ইতিহাস কী, তা নিয়েই আমরা বিস্তারিত জানাব। নূরানী শিক্ষার তরিকায়ে তা’লিম সম্পর্কে আমি ট্রেনিং সেন্টারের আঙ্গিকে বিস্তারিত লেখেছি, প্রয়োজনে দেখে আসতে পারেন।
নূরানী শিক্ষা পদ্ধতির সূচনা
নূরানী শিক্ষা পদ্ধতির প্রবর্তক ছিলেন হযরত মাওলানা ক্বারী মুহাম্মদ বেলায়েত হুসাইন (রহ.)। এটি মূলত একটি সহজ এবং কার্যকর পদ্ধতি, যা শিশুদের আরবি হরফ চেনা, কুরআন পড়া ও উচ্চারণ শেখানোর জন্য প্রবর্তিত হয়।
১৯৩৫ সালে এই পদ্ধতিটি প্রথম চালু করা হয়। এর লক্ষ্য ছিল শিশু এবং নতুন শিক্ষার্থীদের দ্রুত ও সঠিকভাবে পবিত্র কুরআন শেখানো। সময়ের সাথে, এটি বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানসহ উপমহাদেশের বিভিন্ন দেশে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
পদ্ধতির বিশেষত্ব
নূরানী শিক্ষা পদ্ধতি আরবি হরফ, মাখরাজ এবং তাজবীদের উপর গুরুত্ব দেয়।
এর বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলো হলো:
- শিক্ষক প্রশিক্ষণ: কেন্দ্রীয় সেন্টার থেকে নিয়ে সারাদেশে স্থানীয় সেন্টার গুলোতে শিক্ষকদের মানোন্নয়নে ট্রেনিংকোর্সের সু-ব্যবস্থা। এছাড়াও, প্রতিবছর উপজেলা কেন্দ্রিক পুরাতন শিক্ষকদের জন্য তিন দিনের প্রশিক্ষণ কর্মশালার আয়োজন হয় ।
- বোর্ডের উর্ধতন কর্মকর্তাগন বোর্ডে সম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে পর্যবেক্ষণ করেন।
- সহজ ভাষায় উপস্থাপন: যেভাবে উপস্থাপন করলে শিশুরা সহজে শিখতে ও বুঝতে পারবে সেভাবে উপস্থাপন করা হয় ।
- আরবীর পাশাপাশি বাংলা, গণিত, ইংরেজী ও সাধারণ জ্ঞান শিখানো হয় ।
- সুন্দর হস্তলিপির জন্য পৃথক ঘন্টায় মেহনত করা হয়।
- ধাপে ধাপে শিক্ষা: ধাপে ধাপে শিক্ষার মাধ্যমে জটিলতা দূর করা হয়।
- তাজবীদ শেখানো: সঠিক উচ্চারণ ও তাজবীদ অনুযায়ী কুরআন পড়ার কৌশল শেখানো হয়।
- কালিমা, হাদীস ও নামাযের মাসআলা -মাসায়েল শিখানো হয় ।
- সময় সাশ্রয়ী পদ্ধতি: অল্প সময়ে শিক্ষার্থীরা শুদ্ধ কুরআন শিখতে পারে।
সংক্ষেপে নূরানীর ইতিহাস
নূরানী পদ্ধতির মূল ভিত্তি হল আরবি ভাষাকে সহজে যেন শিখা যায় । আরবি ভাষায় অসংখ্য উচ্চারণ জটিলতা থাকায় মাওলানা ক্বারী বেলায়েত হুসাইন (রহ.) এমন একটি কৌশল বা পদ্ধতি তৈরি করেন যা শিশুদের উচ্চারণ ও মাখরাজের শুদ্ধতা নিশ্চিত করে।তৎকালীন সময়ে এই পদ্ধতির একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল এর ব্যবহারিক কৌশল। কুরআন শেখানোর পাশাপাশি, এটি তাজবীদ এবং আরবি ব্যাকরণ শেখাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রবাদ আছে: শক্তির চেয়ে কৌশল বড়, কৌশলে কাজ কর। হযরত ক্বারী বেলায়েত সাহেবের সেই কৌশল গুলোই ট্রেনিংয়ে শিখানো হয় । ক্বারী বেলায়েত সাহেব প্রায় ৬০ বছর গবেষণা করে “নূরানী শিক্ষা পদ্ধতি” আবিষ্কার করেন মোহাম্মদ উল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর এর পরামর্শে ১৯৮১ সালে তিনি ঢাকায় নূরানী কেন্দ্রের কাজ শুরু করেন এবং ১৯৮৪ সালে “নূরানী তালিমুল কুরআন বোর্ড বাংলাদেশ” প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি এই বোর্ডের সভাপতি ছিলেন।চাঁদপুরে নূরানী তালিমুল কুরআন মাদ্রাসা সহ বেশ কয়েকটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করেছেন। তাকে মরণোত্তর “শায়খুল কুরআন” উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে।
মৃত্যু
২০১২ সাল থেকে ব্রেন স্ট্রোক ও বার্ধক্যজনিত কারণে তিনি শয্যাশায়ী ছিলেন। ২০১৭ সালের ২৪ জুন ঢাকার মোহাম্মদপুরের নিজ বাসায় মৃত্যুবরণ করেন। তারাবীর নামাযের পর বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে তার জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। চাঁদপুরে তার প্রতিষ্ঠিত নূরানী তালিমুল কুরআন মাদ্রাসা সংলগ্ন কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
বর্তমান প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের প্রতিটি মসজিদ-মাদ্রাসায় নূরানী পদ্ধতির বই ব্যবহার করা হয়। এর জনপ্রিয়তা এখনো অটুট এবং এটি ইসলামী শিক্ষার একটি ভিত্তি হয়ে উঠেছে। বর্তমানে আপনার আদরের সন্তানকে প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে এই নূরানী পদ্ধতির শিক্ষাকে নির্বাচন করতে পারেন। কারণ এখানে দ্বিন-ইসলাম শিখানোর পাশাপাশি জ্যানারেল নলেজ ও শিখানো হয়। যেমন: বাংলা, গণিত, ইংরেজী ও সাধারণ জ্ঞান । আমরা পর্যবেক্ষণ করে দেখছি যে, এই প্রতিষ্ঠানগুলো কোন কোন গ্রামে ২টি, ৩টি করেও আছে । ইহাতে বুঝতে পারেন এই প্রতিষ্ঠানের জনপ্রিয়তা কেমন ?
নূরানী বোর্ড
নূরানী বোর্ড আমার জানা মতে তিনটি আছে একটি হচ্ছে নূরানী তা’লিমুল কুরআন বোর্ড বাংলাদেশ (ঢাকা বোর্ড)। যার আবিষ্কারক কারী বেলায়েত সাহেব (রাহ:) ।আরেটি হচ্ছে চট্টগ্রাম বোর্ড যার প্রতিষ্ঠাতা হচ্ছেন শাহ আহমদ শফী সাহেব (রাহ:)আরকটি হচ্ছে নূরানী চটকিবাড়ি বোর্ড, যার প্রতিষ্ঠাতা হচ্ছেন ডা. শফিউল্লাহ সকল বোর্ডের আরবি পড়ানোর পদ্ধতিগুলো একই, পার্থক্য হচ্ছে শুধু ইংলিশ বাংলা গণিত সাধারণ জ্ঞান এগুলোর মধ্যে। কিন্তু শেখানোর কৌশল বা পদ্ধতি প্রায় সবগুলোর একই । কেউ চট্টগ্রাম বোর্ডের বই পড়ায়, কেউ নোয়াখালী চটকী বাড়ী বোর্ডের বই পড়ায়, আবর কেউ ঢাকা বোর্ডের বই পড়ায়।
উপসংহার
নূরানী শিক্ষা পদ্ধতি শুধুমাত্র একটি শিক্ষার মাধ্যম নয়; এটি একটি ঐতিহ্য, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ইসলামী মূল্যবোধ রক্ষায় সহায়ক ভূমিকা পালন করে আসছে। “টিস-কম্পিউটার” এই ঐতিহ্যকে লালন করে এবং আপনাদের জন্য আরও মূল্যবান তথ্য ও শিক্ষামূলক উপাদান প্রদান করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।