পৃথিবীর প্রতিটি মানুষই সাফল্যের শুভাকাঙ্ক্ষী। কিন্তু সাফল্য কারও শুভাকাঙ্ক্ষী নয় । এখানেই মানুষের ব্যর্থতা; অথচ সাফল্য কারও জন্ম দেয়নি বরং মানুষই সাফল্যের জন্মদাতা ব্যক্তি জীবনে উন্নতির স্বপ্ন দেখেন না এমন একটি মানুষও জগতে খুঁজে পাওয়া দুস্কর। কিন্তু তার পরও ব্যর্থ মানুষের সংখ্যাই জগতে বেশি। এর কারণ হচ্ছে সফলতার পদ্ধতি-জ্ঞান-প্রস্তুতি সম্বন্ধে অজ্ঞতার জন্যই সবাই সফলতার মুখ দেখেন না । জীবনে সফল হওয়ার জন্য ব্যক্তির যা প্রয়োজন তা প্রতিটি মানুষের মাঝেই অবচেতন অবস্থায় পড়ে আছে; প্রথমে আসে মনোবল দৃঢ় মনোবল আপনাকে এনে দেবেন কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছার অদম্য চেতনাবোধ। মনোবলকে কাজে লাগাতে আত্ম-বিশ্বাস অত্যন্ত ফলপ্রসূ। প্রতিটি মানুষের জীবনে উন্নতির সোপান তৈরী করাই তার সফলতা । যারা নিজেকে বিজয়ীর আসনে দাঁড় করানোর ইচ্ছা পোষণ করেন না, তারা কখনও বিজয়ী হওয়ার আশাও করতে পারেন না। তাই ব্যক্তির কাজ সাফল্যের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করা। How to Magic of Succes অর্থাৎ যাদুকরী সাফল্য অর্জনের সন্ধান অথবা কীভাবে যাদুকরী সাফল্য অর্জন করা যায়, তার একটা কর্মপন্থা (Action plan) তৈরী করা।
কর্মপন্থা (Action plan) হবে নিম্নরূপঃ
প্রতিটি মানুষের সাফল্য অর্জনের জন্য দরকার ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন পদক্ষেপ। (Steps to success of positive attitude)। ব্যক্তি জীবনে সাফল্য অর্জনের ক্ষেত্রে ইতিবাচক মনোভাবের একটি উদাহরণ না দিলে বিষয়টি হয়তো অজানাই থেকে যাবে। ফরাসীর বিখ্যাত সম্রাট নেপোলিয়ান যখন তার সেনাবাহিনীসহ আল্পস পর্বতের নিকট উপস্থিত হলেন। তখন সৈন্যদের মনে নেতিবাচক প্রভাব দেখে তিনি অসীম উৎসাহে বলে উঠলেন, “There will be no Alps.” অর্থাৎ আমাদের বিজয় অভিযানের সম্মুখে আল্পস পর্বত থাকবে না। আত্ম-শক্তি সম্বন্ধে নেপোলিয়ানের এ ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি (Positive attitude) দ্বারা (Will) দৃঢ় ইচ্ছাশক্তির সীমাহীন প্রভাব তৈরী করে দেয়। যা তার সৈন্যদের দুর্গম গিরি তুচ্ছ করে বিজয় মুকুট অর্জনের সাফল্য এনে দিয়েছিল। জীবনে কখনও ব্যর্থতার হিসেব কষবেন না।
জীবন ব্যর্থতার সঙ্গী নয়। মানুষ যেখানে জীবনের অস্তিত্বও সেখানে। মানুষ কর্মের দ্বারা সফলতার সন্ধান লাভ করে আর অবহেলা, অবজ্ঞা ও অজ্ঞতার বশে ব্যর্থতার সাক্ষাত পায়। প্রকৃতপক্ষে ভুলের সমষ্টির নাম ব্যর্থতা। মানব জীবনের ছোট বড় ভুলগুলোই ব্যর্থতার সমাধি রচনা করে। মানুষের অবচেতন মন বার বার ভুলের দিকে ধাবিত হয়। তাই তার অবচেতন বৃত্তিকে জাগিয়ে তোলার উপায়, গভীর চেতনাবোধ, চিন্তা শক্তির প্রসার। কোথায় তার সফলতা, কোথায় তার ব্যর্থতা এ বোধ তার মেধায় এসে ধরা দেবে যখন সে সুস্থ মনে গভীর চেতনাবোধে প্রবেশ করবে। মানুষ হিসেবে আপনার আত্ম-প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা; কর্মের প্রতি দৃঢ় মনোবল ও ইচ্ছা শক্তির গভীর প্রয়াস আপনাকে সীমাহীন শক্তির সন্ধান দেবে। যে শক্তি আপনার মনের গভীরে অবচেতন ভাবে পড়ে ছিল ।
একটি গল্প:
এ প্রসঙ্গে একটি গল্প মনে পড়ে যায়। এক কৃষক প্রতিদিন কাজের সন্ধানে গৃহ ত্যাগ করেন কিন্তু কিছুতেই তার কাজ জোটে না। একদিন সে ক্লান্ত হয়ে পাহাড়ের ঢালুতে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিল । হঠাৎ দেখতে পেল এক বৃদ্ধ পাহাড়ের শক্ত মাটি কুপিয়ে তাতে জুম চাষের ব্যবস্থা করছেন, কৃষক বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি এত শক্ত মাটি উর্বর করে ফসল ফলাতে পারবেন তো? বৃদ্ধ গভীর মনোবলের সহিত বললেন, মরুভূমিতে যদি গাছ জন্মে তাহলে আমার শক্ত মাটিতেও ফসল ফলবে। বৃদ্ধের এ কথার জবাবে কৃষকের স্বীয় অনুর্বর ডাঙ্গা জমির কথা মনে হল।
সে বুঝতে পারল আমি এতদিন বৃথা কাজের সন্ধান করেছি। আমার নিজের জমিতেই যে ফসল হবে তাতে কিছুটা হলেও অভাব দূর হবে। এ গল্প থেকে আমরা যে শিক্ষা পাই তা হলঃ কৃষক গভীর মনোবল ফিরে পেল; তার ভেতরের অবচেতন বৃত্তি তাকে তাড়া করল যে, তার নিজেরই কত কাজ পড়ে আছে । বৃথা সে অন্যের কাজের সন্ধানে সময় নষ্ট করছে। কাজেই মনোবল ঠিক করুন। আপনার ব্যক্তিগত কোন্ গুণগুলি আপনাকে মর্যাদা এনে দিতে পারে, যা অন্যের নেই । অথবা আপনার এমন অনেক কিছুই করার আছে যা করলে আপনার আত্ম-মর্যাদা ও জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ ত্বরান্বিত হবে। সে কাজের প্রতি গভীর মনোযোগী হয়ে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করুন। তারপর কাজে যোগ দিন, আপনি অবশ্যই সফল হবেন ।
সাফল্য লাভের উচ্চাকাঙ্ক্ষা
আপনি বিজয়ী হতে চান। এ চাওয়াটাই আকাঙ্ক্ষা এবং যখন গভীরভাবে নিবিষ্ট হয়ে কোন কিছু প্রত্যাশা করবেন তখনই আপনার উচ্চাকাঙ্ক্ষা পোষণ হবে। উচ্চাকাঙ্ক্ষা বলতে শুধু সাফল্য লাভের আকাঙ্ক্ষাই নয়; ব্যক্তিত্বের বিকাশ ও সাফল্যের স্বর্ণ শিখরে আরোহণ করার অভিব্যক্তিই সাফল্য লাভের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ।পৃথিবীতে কোন মানুষই সফল হয়ে জন্ম নেননি বরং জন্মের পরে কঠোর অনুশীলন ও অধ্যবসায়ের দ্বারা সাফল্যের ভীত রচনা করেছেন। এ কথার পুনরাবৃত্তি করলে আমরা জানতে পারি “সাফল্য মানুষের জন্ম দেয় না বরং মানুষই সাফল্যের জন্মদাতা।” উপরোক্ত কথাটিই চিরসত্য।
যদি তাই হয় তাহলে সাফল্য লাভের পন্থা আপনাকেই খুঁজে বের করতে হবে। আমরা যখন পৃথিবীতে সব সফল মানুষের জীবনী পর্যালোচনা করি, তখন অনায়াসেই জানতে পারি সাফল্য অর্জনের প্রস্তুতি ও ধাপের কথা। কীভাবে মহামানবগণ ধাপে ধাপে সাফল্যের চূড়ায় উন্নীত হয়েছেন, তার পথ পরিক্রমা না জানলে আমরা কখনই ব্যক্তি জীবনে সফলতার চূড়ায় উন্নীত হতে পারব না। পৃথিবীর সব মানুষই সাফল্য অর্জনের শুভাকাঙ্ক্ষী। কিন্তু সাফল্য অর্জনের পন্থার সন্ধান সবাই করেন না।
এখানেই তার জীবনে ব্যর্থতা নেমে আসে। প্রকৃতপক্ষে সাফল্যের শুভাকাঙ্ক্ষীরা সাফল্য লাভের পন্থা বা পরিক্রমার সন্ধান করেন এবং কঠোর অনুশীলনের মাধ্যমে তা বাস্তবায়নের দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত করেন। এভাবেই তারা জীবনে সাফল্যের সন্ধান পান। আমরা অনেকেই সাফল্যের উচ্চাকাঙ্ক্ষা পোষণে ভুল করি। কাজের পূর্বেই লাভের অঙ্কটা কষতে থাকি; আমাদের এ উচ্চাকাঙ্ক্ষা উচ্চাকাঙ্ক্ষাই থেকে যায়। আমরা তখন আমাদের স্বপ্নগুলো বাস্তবায়ন করতে পারি না। আমাদের সকল প্রকার উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য চাই ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন দৃঢ় প্রত্যয়। আর-এ প্রত্যয় পূরণের জন্য যা দরকার তা হচ্ছে;
তীব্র আকাঙ্ক্ষা অধ্যবসায় ও আত্ম-বিশ্বাস
তীব্র আকাঙ্ক্ষার জোরে পৃথিবীতে বহু ব্যক্তিই অসাধ্যকে সাধন এবং কঠিনকে তরলে পরিণত করেছেন। এর অনেক নজীর চোখে পড়ে। সুতীব্র আকাঙ্ক্ষাই পক্ষাঘাতগ্রস্ত উইলমা রুডলফকে দৌড়ে পৃথিবীর দ্রুততম মহিলা হিসাবে ১৯৬০ সালের অলিম্পিকে তিনটি স্বর্ণপদক জিতিয়ে বিশ্ব সেরার খ্যাতি অর্জনের সাফল্য দান করেছিল।
৮. গ্লেন কানিংহামের কথায়, “পুড়ে যাওয়া পা নিয়ে একটি ছেলে একমাইল পথ দৌড়ে বিশ্ব রেকর্ড করেছিল; কেবল তীব্র আকাঙ্ক্ষার তাড়নায়।’ আপনার কার্যসিদ্ধির আকাঙ্ক্ষা, লক্ষ্য, অভীষ্ট লাভের মূলমন্ত্র কঠোর শ্রমের মাঝেই নিহিত। এ লক্ষ্যে পৌঁছানোর শৃঙ্খলাবোধই হচ্ছে, তীব্র আকাঙ্ক্ষা, দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি, অধ্যবসায় ও আত্ম-বিশ্বাস। এই সমস্ত গুণাবলীকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারলেই আপনি সফল । আকাঙ্ক্ষা যখন গভীর হবে, আত্ম-বিশ্বাস যখন সুদৃঢ় হবে, তখন যদি আপনি নিজেকে অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের নিমিত্তে একাগ্রতার সাথে কাজে অগ্রসর হন, তাহলে আপনি সাফল্যের দ্বার প্রান্তে পৌছাতে পারবেন এতে সন্দেহ নেই ৷ মানুষ পারে না এমন কাজ পৃথিবীতে নেই।
মিশরের সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম নিদর্শন পিরামিডগুলোর দিকে তাকিয়েই পৃথিবীর হাজার হাজার পর্যটক বিস্ময়ে আবির্ভূত হয়ে বলেছিল, কীভাবে আদিম যুগের মানুষ অত উঁচুতে পাথরগুলো উত্তোলন করেছিল। তখন প্রযুক্তির এত উন্নয়ন হয়নি। আবিস্কৃত হয়নি আধুনিক কোন কিছুই; কিন্তু তবুও মানুষের অসাধ্য ইচ্ছাগুলোকে তারা পূরণ করে তৈরী করেছে এমন কিছু যা আজও মানুষ বুঝে উঠতে পারেনি। দান মিশরের সেই সুবিখ্যাত তিনটি পিরামিডের মধ্যে সবচেয়ে বড় পিরামিডটি হলো খুফুর পিরামিড। এটির উচ্চতা ৪৮১ ফুট। জানা যায় এক লাখ লোক ২০ বছর কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে এই বিখ্যাত পিরামিডটি তৈরী করেছিল। এই পিরামিডটিই সপ্তাশ্চর্যের একটি।
সবুজ মাঠের শেষে মরুভূমি যেখানে শুরু হয়েছে সেখানেই পিরামিডগুলো তৈরী করা হয়েছিল । এই মরুভূমির প্রান্তের পাহাড় থেকে তামার ছুরি ও ছেনি দিয়ে পাথর কেটে, সেই পাথর দিয়ে যে-সব বাড়ি মানুষ নির্মাণ করেছিল। তা দেখে আজও পৃথিবীর মানুষ বিস্ময় প্রকাশ করে। সেই অনুন্নত প্রাচীনকালে তারা এত শক্ত পাথর সুন্দরভাবে কীভাবে কাটল এবং পাথর দিয়ে কেমন করে যে বাড়ির ছাদ তৈরী করলো, কেমন করেই বা তারা অত ভারী পাথর অত উচুঁতে তুলেছিল, আজ পর্যন্ত এর রহস্য মানুষ উদ্ধার করতে পারেনি।
অথচ মানুষ তার তীব্র আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়িত করেছে, অসম্ভবকে সম্ভবের মাধ্যমে । মানুষ প্রামাণ করেছে সে তার ইচ্ছাশক্তিকে কাজে লাগিয়ে দুর্গমকে সুগমে, দুর্জয়কে জয়ে এবং দুর্ভাগ্যকে সৌভাগ্যে পরিবর্তন করতে পারে। মহান করুণাময় আল্লাহ তায়ালা মানুষকে সীমাহীন শক্তির অধিকারী করেছেন জ্ঞান- বুদ্ধির মাধ্যমে । কিন্তু তিনি স্পষ্টভাবে মানুষকে বলে দিয়েছেন, যে এ শক্তিকে যথাযথ ব্যবহার ও কাজে লাগাতে পারবেন সেই এ সীমাহীন শক্তির অধিকারী হবেন। অতএব এ শক্তি আপনাকে অর্জন করে নিতে হবে।
তাইতো স্রষ্টা পবিত্র কোরআন মাজীদে ঘোষণা দিয়েছেন, “যে জাতি নিজের ভাগ্য পরিবর্তনে এগিয়ে আসে না স্বয়ং স্রষ্টাও তার ভাগ্য পরিবর্তন করেন না।” স্রষ্টা প্রতিটি মানুষকেই সীমাহীন এক চেতনাশক্তির অধিকারী করে সৃষ্টি করেছেন। এ শক্তি প্রতিটি মানুষের মাঝেই অবচেতন অবস্থায় পড়ে আছে। এ শক্তির প্রবাহকে গতিময় করতে হবে। তীব্র স্রোতস্বিনী নদীকে যেমন শেওলা ও ছত্রাক ঘ্রাস করতে পারে না। কোন ব্যক্তি যদি তার মনের অবচেতন বৃত্তিকে জাগিয়ে তুলতে পারে তাহলে এ শক্তির ধারা তাকে গভীর আত্ম-বিশ্বাসে বলীয়ান করে তুলবে; ফলে সে দ্রুত সাফল্যের দ্বার প্রান্তে পৌছাতে সক্ষম হবে ।
পাথর ঘষতে ঘষতে যেমন এক সময় তা ক্ষয় হয়, তেমনি আপনার মাঝেই লুকিয়ে আছে, এক অদ্ভুত সম্ভাবনার দীপ্তি; কঠোর শ্রম ও অধ্যবসায়ের দ্বারা তাকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারলেই যে কোন অসম্ভবকে আপনি সহজেই সম্ভবে পরিণত করতে পারবেন । আপনার আকাঙ্ক্ষা গভীর, আত্ম-বিশ্বাস সুদৃঢ় এবং অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের কর্মপন্থা (Action plan) অনুযায়ী আপনি ইতিবাচক মনোভাবের দৃঢ় প্রত্যয়ী আপনি অবশ্যই সফল হবেন; যদি সত্যিই আপনার আকাঙ্ক্ষা হয় তীব্র থেকে তীব্রতর।
সাফল্যের তড়িৎ প্রবাহের সুতীক্ষ্ণ সীমাহীন শক্তির উৎস হল দৃঢ়তার সাথে এগিয়ে যাওয়া। ফরাসীর বিখ্যাত সম্রাট নেপোলিয়ানের মতে, “মানুষের মন যে আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে, কল্পনায় ব্রতী হয় এবং দৃঢ় ইচ্ছাশক্তির দ্বারা আত্ম-বিশ্বাসের সাথে অগ্রসর হয় সে অবশ্যই তাতে সাফল্য লাভ করে। ‘ মহাজ্ঞানী সক্রেটিস রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে হেঁটে যাওয়া তরুণদেরকে জ্ঞানের কথা শোনাতেন। সাফল্য লাভের নানা কৌশলের সন্ধান দিতেন। নৈতিক, আত্মোন্নয়নসহ দর্শন ও নানা বিষয়ের প্রতি তরুণদের কৌতূহল বাড়ানোই ছিল সক্রেটিসের কৌশলী রসহ্য জ্ঞান ভাণ্ডার ।
সক্রেটিস একদিন এথেন্সের পথ ধরে যাচ্ছিলেন। এক ক্ষুদে তরুণ হঠাৎ তার সামনে এসে জিজ্ঞেস করল, সাফল্য লাভের রহস্য কি; সক্রেটিস দাঁড়িয়ে ক্ষণিক ভাবলেন তারপর পরের দিন তাকে নদীর ধারে আসতে বললেন। পরদিন নদীর ধারে দেখা হবার পর দু’জনে জলের দিকে এগোতে থাকলেন; এভাবে এক গলা জলে গিয়ে উভয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। সক্রেটিস কিছু না বলে হঠাৎ ছেলেটির ঘাড় ধরে পানিতে ডুবিয়ে দিলেন। ছেলেটি পানির নিচ থেকে যতবার মাথা উপরে তোলবার চেষ্টা করল সক্রেটিস ততবারই তাকে পানির নিচে ডুবিয়ে দিলেন। এভাবে সাতবার ছেলেটির মাথা পানিতে উঠানামা করালেন। বাতাসের অভাবে ছেলেটির মুখমণ্ডল নীল হয়ে গেল। সক্রেটিস এবার তার মাথাটি পানির উপরে তুললেন। ছেলেটি হাঁসফাঁস করে বুক ভরা
নিঃশ্বাস নিল। সক্রেটিস ছেলেটিকে বলল, “যতক্ষণ তুমি পানির নিচে ছিলে ততক্ষণ আকুলভাবে কি চাইছিলে?” ছেলেটি জবাব দিল ‘বাতাস’। সক্রেটিস এবার জানিয়ে দিলেন এটিই সাফল্যের রহস্য। তুমি যেভাবে বাতাস চাইছিলে সেইভাবে যখন সাফল্য চাইবে তখনই তুমি সাফল্যের সাক্ষাৎ পাবে। তীব্র উচ্চাকাঙ্ক্ষার চেয়ে সাফল্যের কোন গূঢ় রহস্য নেই। আপনার উদ্দেশ্য প্রথমবার সফল নাও হতে পারে; কিন্তু তাই বলে বিচলিত হবেন না, চেষ্টা চালিয়ে যান, অধ্যবসায়ে লেগে থাকুন; অন্তত সাতবার চেষ্টা না করা পর্যন্ত হাল ছাড়বেন না ।
যদি কর্মের প্রতি আপনার দৃঢ় প্রত্যয় থাকে, নিজের প্রতি আত্ম-বিশ্বাস থাকে, অদম্য ইচ্ছাশক্তির অভিব্যক্তি থাকে, তাহলে এ গুণগুলিই আপনাকে কঠোর পরিশ্রমে লিপ্ত করে সীমাহীন কর্মোদ্দীপনা সঞ্চার করবে। আপনার এ কর্মোদ্দীপনাই যোগাবে প্রচেষ্টাকে চালিয়ে যাবার চেতনা শক্তি, ফলে সাফল্য আপনার অবধারিত। হয়তো আপনি যা পরিকল্পনা করেছেন হতে পারে সে লক্ষ্যবস্তুটি আপনার যোগ্যতার উর্ধ্বে; কিন্তু তাই বলে ভীত বা সংকুচিত হবেন না। কারণ আপনার মাঝে যে সীমাহীন শক্তি লুকিয়ে আছে; তা হয়তো আপনার জানা নেই। আপনি সে শক্তির আবিস্কারক। এ শক্তির প্রবাহকে গতিময় করে তুলতে আপনাকে সাফল্যের ধারাবাহিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
অভিজ্ঞতা, মেধা, শ্রম এবং উদ্দেশ্য যদি একযোগে প্রয়োগ করার প্রত্যয় দৃঢ়ভাবে আপনার মনে সংকল্প জাগায় তবে অসম্ভব কর্মপ্রেরণার গতি সঞ্চারিত হবে আপনার সকল কাজে, ফলে, প্রতিটি ধাপে ধাপে আপনি সফলতার দ্বারে পৌঁছতে সক্ষম হবেন। এক্ষেত্রে অবশ্যই আপনাকে সীমাহীন আত্ম-শক্তিতে বলীয়ান হতে হবে ।এবার আত্ম-বিশ্লেষণ করুন, আপনার আমিত্বের গতি প্রকৃতি কর্মের প্রতি গভীর আস্থাশীল কিনা জেনে নিন । বুঝে নিন আপনার মানসিক দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ্য অর্জনে কতটুকু ক্রিয়াশীল। এভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার অদম্য চেতনাবোধই আপনার ভেতরের লুকানো শক্তির পরিচয়
আপনি হয়তো দেখেছেন, রেল লাইনের দু’ধারে গাদাগাদি করে পাথর বসানো থাকে। সেগুলো শীতকালে বেশ ঠাণ্ডা হয়। কিন্তু আপনি যদি একটি পাথর হাতে নিয়ে লোহা অথবা কোন ধাতুর সাথে ঘষতে থাকেন। তাহলে কিছুক্ষণ পরে দেখবেন দু’টিই বেশ গরম হয়েছে। আবার পরস্পর দু’টি পাথর একত্রে কিছুক্ষণ ঘষলে দেখবেন এক সময় অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বের হচ্ছে। এবার পরীক্ষামূলক আপনার নিজের হাতটি একটি টেবিলের উপর রাখুন। হয়তো শীতকাল বলে টেবিলটি বেশ ঠাণ্ডা। এবার ঘষতে থাকুন। দেখবেন এক সময় টেবিল ও হাত দু’টিই বেশ গরম হয়েছে। একটু আগেই যে টেবিলটি শীতল ছিল। তা আপনার হাতের ঘর্ষণের ফলে, লুকানো উত্তাপ পেয়ে গরম হয়ে গেছে। এবার একটু ভাবুন তো যে লুকানো উত্তাপটি টেবিল ও হাত উভয়কেই গরম করে তুলল সেটি এক প্রকার শক্তি। ঠিক বাষ্প শক্তির মতই জ্বলন্ত এর গতি ।
ফুটন্ত কেটলির ঢাকনা নড়তে দেখে বাল্যকালে যার মনে একটি নতুন চিন্তার উদয় হয়েছিল তা হল; একটি শক্তির সম্ভাবনার কথা। শক্তিই শুধু কোন বস্তুকে নাড়াতে পারে। তাহলে পানিতে তাপ দিলে যে বাষ্প তৈরী হয় তা নিশ্চয়ই শক্তি তৈরীর কাজে ব্যবহার করা চলে। এভাবে তার ভেতরে যে সীমাহীন চেতনাবোধ তৈরী হয়েছিল তিনি তাঁর ভেতরের লুকায়িত প্রতিভাকে কাজে লাগিয়ে বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিস্কার করতে সমর্থ হন। এ সবই শক্তির কাজ। আপানার ভেতরের লুকানো উত্তাপকে ক্রিয়াশীল করে আপনার চেতনাশক্তি যা পরবর্তীতে একক শক্তিরূপে বিকশতি হয়। এ শক্তিই ব্রিটিশ বৈজ্ঞানিক জেমস্ ওয়াটকে বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিস্কারে সফলতা দান করেছিল। এ আবিস্কারের জন্য তাকে অনেক সমস্যা সংকুল পথ ধরে চলতে হয়েছে; করতে হয়েছে নিরলস সাধনা এবং অক্লান্ত পরিশ্রম ।
আজকের পৃথিবীতে যত অভিনব ইঞ্জিন দেখা যায় তা জেমস্ ওয়াটেরই কৃতিত্ব। জেমস্ ওয়াটেরই ইঞ্জিনের পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত রূপ। এই ইঞ্জিন আবিস্কার হওয়ার পর যোগাযোগ, শিল্প-কারখানা এবং বিভিন্ন কাজে শুরু হল অভূতপূর্ব উন্নতি। বিশ্ব এগিয়ে যেতে থাকল দূরন্ত গতিতে। শিল্প বিপ্লবের মূল ব্যক্তিত্ব জেমস্ ওয়াট ১৭৩৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন।
বিশ্ব সভ্যতাকে বিকশিত করার জন্য আবিস্কারের ইতিহাসে জেমস্ ওয়াট সর্বকালের এক অনন্য সাধারণ ব্যক্তিত্ব রূপে আত্ম-প্রকাশ করেন। বিশ্ববাসী তাঁর এ যুগান্তকারী অবদানকে কোনদিন ভুলবে না। তিনি মানুষের পক্ষে সবই সম্ভব। মানুষ পারেনি পৃথিবীতে এমন কাজ নেই । মানুষ সবই পারে। মানুষ চাঁদে গিয়েছে। মঙ্গল গ্রহে পাড়ি দিয়ে এসেছে। পাখিকে উড়তে দেখে সে বিস্ময়ে আকাশে উড়বার বাসনায় তীব্র আকাঙ্ক্ষার তাড়নায় পড়ে সীমাহীন চেতনা শক্তির দ্বারা উড়োজাহাজ বানাতে সমর্থ হয়েছে। প্রাচীন ঘোড়ার গাড়ীর পরিবর্তে পরিবহন ব্যবস্থার জন্ম দিয়েছে। পরাশক্তিধর হওয়ার বাসনায় মত্ত হয়ে অত্যাধুনিক যন্ত্র আবিস্কার করেছে। মানুষ এভাবে কত কল্পনাকে বাস্তবে পরিণত করেছে; কত অসম্ভবকে সম্ভবে রূপদান করেছে। মানুষের এ অসম্ভবকে সম্ভবে পরিণত করার মনোবৃত্তি তার তীব্র উচ্চাকাঙ্ক্ষার গতিময় পদক্ষেপের ফলাফল।
প্রতিটি মানব শিশুই স্রষ্টার দেয়া প্রতিভা নিয়ে জন্ম গ্রহণ করেন। কেউ তাকে লালন ও পরিচর্যা করে সাফল্যের দিগন্তে উন্নীত হন। আবার কেউ তাকে অযত্নে-অবজ্ঞায় ফেলে অজ্ঞাত সারে নিজ প্রতিভার অপমৃত্যু ঘটান। বাস্তবে আপনি একটা তীক্ষ্ণ ধারালো ছুরি কয়েকদিন অযত্নে মাটিতে ফেলে রাখুন। বেশ কিছুদিন পরে দেখবেন তাতেও মরিচা ধরে নষ্ট হয়ে গেছে। তখন ঐ ছুরি দিয়ে কোন কিছুই কাটা সম্ভব হবে না। অথচ একখণ্ড আস্ত লোহাও যদি প্রতিদিন ঘষতে থাকেন; তবে সেটিও ক্রমে ক্রমে তীক্ষ্ণ ধারাল হতে থাকবে ।
সুতরাং আপনার একান্তই ব্যক্তিগত যে প্রতিভা আছে। অভিজ্ঞতা আছে, মেধাশক্তি আছে, কাজ করার জন্য পেশি শক্তি আছে, সুস্থ দু’খানা হাত, দু’খানা পা, সুদৃষ্টি সম্পন্ন দু’টি চোখ এবং সর্বপরি আপাদমস্তক সুস্থ সবল আছে। তাহলে আর ভাবনা কি। এবার প্রয়োজন স্বপ্ন (Dreams) কর্মপন্থা (Action plan) লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য (Objective set) প্রতিষ্ঠা করার দৃঢ় সংকল্প। এবং মেধাশক্তিকে সযত্নে কাজে লাগিয়ে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যান । দেখবেন আপনার প্রতিভায় সীমাহীন গতি প্রবাহের সৃষ্টি হয়েছে। স্মৃতিশক্তির ভাণ্ডার ক্রমে ক্রমেই সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর হয়ে উঠেছে। মেধাশক্তি এক নতুন শক্তির সন্ধান লাভ করেছে। যে শক্তি আপনার অগোচরেই অবচেতনভাবে লুকিয়েছিল। এবার আপনি সাফল্যের সম্ভাবনার দিকে ক্রমে ক্রমেই ধাবিত হচ্ছেন (You must be chance of success)।
আমি পাঠক হিসেবে আপনাকেই খুঁজছি। আপনি যে পেশারই হোন না কেন। সাফল্য অর্জনের পন্থা মূলত একই। যে যে পেশাতেই সফল হতে চান তাদের প্রত্যেকেরই উপরোক্ত গুণগুলি থাকতে হবে। আমি আপনাকে একজন শিক্ষার্থী হিসাবে চিহ্নিত করছি। পেশায় আপনি একজন ছাত্র নয়তো চাকুরীজীবি যাই হন। আপনার ইচ্ছাশক্তি পূরণের পন্থা একই।
- আকাঙ্ক্ষাকে জোরদার করতে চান?
- জীবনে অনেক বড় হতে চান?
- সাফল্যের দ্বার প্রান্তে পৌঁছাতে চান?
তাহলে নিজেকে প্রশ্ন করুন? কোন্ দিকটি, কোন্ বিষয়টি, কোন্ পথটি আপনার ভাল লাগে। অথবা কোটি আপনার অনুকূলে । একটি সাধারণ মত প্রকাশ করুন। এ মতের অনুকূলে আপনার যুক্তি ও অভিমত ব্যক্ত করুন। এভাবে একাধিক মত প্রকাশ করে যেটির পক্ষে যুক্তি ও অভিমত সবচেয়ে কার্যকরী বলে মনে হবে সেই বিষয়টিকে আপনার সাফল্যের লক্ষ্য বস্তু মনে করে তীব্র আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করুন। কোন্ পন্থা অবলম্বন আপনার পক্ষে ভাল? আপনার আত্ম-বিশ্বাস কি স্বপক্ষে সুদৃঢ়? আসলে আপনি কি হতে চান? সেই লক্ষ্য বস্তুতে পৌঁছাতে কি কি লাগতে পারে ভেবে নিন। যা যা প্রয়োজন তা কি আপনার পক্ষে মেটানো সম্ভব?
সবকিছু ভেবে-চিন্তে লক্ষ্য স্থির করুন ।
মনে রাখবেন লক্ষ্য নির্ধারণ করে লক্ষ্যে পৌঁছানোর মাঝেই সফলতার হাতছানি (Setting and achieving your goals to success) বড়। তারপর লক্ষ্যের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করুন (Keep your eyes upon the goal) আপনি যদি পেশায় ছাত্রই হয়ে থাকেন তাহলে লক্ষ্য নির্ধারণ করে তবেই পড়া-লেখার গতি নির্ণয় ও সে অনুযায়ী পন্থা বের করতে হবে। নিজেকে কঠোর অনুশীলনে নিক্ষেপ করতে হবে।
আপনার লক্ষ্যকে যদি একটি কর্ম-পরিকল্পনার ভিত্তিতে (Action plan method) পরিচালিত করতে পারেন, তবে আপনার এ লক্ষ্যই মনে কঠিন আকাঙ্ক্ষার জন্ম দেবে যা আপনাকে অদম্য শক্তির অধিকারী করে তুলবে। যে শক্তি সঞ্চয়ের মাধ্যমে আপনি নিজের উদ্দেশ্যগুলোকে একের পর এক বাস্তবায়ন করতে পারবেন।
পরিকল্পনা অনুযায়ী আপনাকে ফর্মূলা তৈরী করতে হবে। এ ফর্মূলাকে আপনি নিজের প্রয়োজনে যে কোন পেশায় ব্যবহার করে সফলতার সম্ভাবনার দিকে অগ্রসর হতে পারবেন। আপনার হাতের কাছে একটি ডাইরী রাখুন। ডাইরীটার নাম আমার কাছ থেকে জেনে নিন। লিখুন, (Self-Improvement) সেল্ফ ইম্প্রুভমেন্ট ডাইরী অর্থাৎ আত্মোন্নয়নের ডাইরী। এই ডাইরীতে আপনার পদক্ষেপগুলো সুন্দরভাবে লিখে রাখুন । আপনি কি হতে চান?
আপনি লক্ষ্যবস্তু অর্জনে কতদূর অগ্রসর? আর কি কি প্রয়োজন হতে পারে। মনে রাখবেন, পরিকল্পনা ও স্বপ্ন বাস্তবায়নের দৃঢ় সংকল্প ছাড়া আপনি কখনই সফল হতে পারবেন না। সুতরাং অবহেলায় অবজ্ঞায় সময় নষ্ট করে নিজেকে ব্যর্থতার কাঠগড়ায় দাঁড় করাবেন না। আপনার ভুলে গেলে চলবে না । এ পৃথিবী এক বিশাল কর্মক্ষেত্র। এখানে সবাই প্রতিযোগি। আলস্য ধুকে ধুকে মার খাবে এটা চিরাচরিত
স্রষ্টার দেয়া শক্তিকে কাজে লাগিয়ে আপনি হতে পারেন জগৎ সেরা। সত্য-নিষ্ঠা ও কঠোর অধ্যবসায়ই আপনার ধর্ম। তাই মিথ্যার ভিত্তিতে স্থায়ী কোন ভবিষ্যৎ গড়া যায় না। আর এতে সাফল্যের চাইতে ব্যর্থতাই বেশি আসে। অতএব সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়তে, জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে, আত্ম- বিশ্বাস ও আন্তরিকতার সাথে কঠোর পরিশ্রম করে যান আপনি অবশ্যই সফল হবেন।
জ্ঞানের সন্ধান-জ্ঞানীর সন্ধান
গ্রীক দার্শনিক ও মহাপণ্ডিত সক্রেটিস হযরত সোলায়মান (আঃ) সাল্লামের নৈতিক শিক্ষা ও আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে জ্ঞানের মহাসাগরের সন্ধান লাভ করেছেন। তাই তাঁর শিক্ষা ও আদর্শ হয়েছে সার্বজনীন। তাঁর দর্শন হয়েছে জীবন্ত, জীবনমুখি (Know thyself) নিজেকে জানো, যা স্রষ্টা-সৃষ্টির রহস্যে রহস্যায়িত জ্ঞানের ভাণ্ডার স্বরূপ ।
যে জ্ঞান সক্রেটিস তাঁর শিষ্য বিশ্ব নন্দিত দার্শনিক প্লেটোকে শিক্ষা দিয়েছিলেন, প্লেটো শিক্ষা দিয়েছেন, মহাজ্ঞানী এ্যারিস্টটলকে, এ্যারিস্টটল শিক্ষা দিয়েছেন বিশ্বজয়ী মহান বীর আলেকজান্ডার দি গ্রেটকে । এভাবে জ্ঞান যদি পরস্পর পরস্পরায় প্রবাহিত না হয় তাহলে তা বিকশিত হয় না আর বিকশিত না হলে তার প্রবাহ শুকিয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। তাই আমাদের মহৎ শিক্ষা কখনও স্বার্থকতা লাভ করবে না যদি তা মানুষের ও সমাজের কাজে না আসে। আমরা জানি, যা জীবন্ত ও কল্যাণমুখি মানুষের ও সমাজের উন্নয়নে সহায়ক। আমাদের উচিৎ আগামী প্রজন্মকে এমন নানাবিধ জ্ঞানের সন্ধান দেয়া, আলোকিত জীবনের সন্ধান দেয়া। যা যুগ যুগ ধরে মানব মনের সীমাহীন জিজ্ঞাসাকে মহাজ্ঞানী সক্রেটিসের “Know thyself’–এর মতই আত্ম জীবনের সন্ধান দেবে।
আত্ম-বিশ্বাসের গুরুত্ব
আত্ম-বিশ্বাস ব্যতীত জীবনের কোন ক্ষেত্রেই উন্নয়ন সম্ভব নয়। আত্ম- বিশ্বাস আত্ম-প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ব্যক্তিক উন্নয়ন ও জাতীয় উন্নয়ন ত্বরান্বিত করে। ব্যক্তি জীবনে প্রতিষ্ঠার জন্য যেমন আত্ম-বিশ্বাস দরকার তেমনি মানুষের যাবতীয় কাজের সুফল লাভের ক্ষেত্রেও আত্ম-বিশ্বাসের গুরুত্ব সীমাহীন। আমরা ইতিহাসের পাতা থেকে অনেক কিছুই জানতে পারি। আত্ম-বিশ্বাস ও দৃঢ় প্রত্যয় পোষণকারী বীর সর্ব অবস্থাতেই যুদ্ধে জয়লাভ ও রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে আমরা সম্রাট আকবরকে যেমন জানতে পারি তেমনি বাবর, হুমায়ুন এর আরও বহু নজীর রয়েছে।
আত্ম-বিশ্বাস যেখানে সেখানে হতাশা, দুশ্চিন্তা, মিথ্যা ও মূর্খতার কোন স্থান নেই । সে জন্যেই আত্ম-বিশ্বাসী ব্যক্তির জীবনে দ্রুত সাফল্য অর্জিত হয়। আত্ম-বিশ্বাসে উঠা ব্যক্তি জীবনে সাফল্যের অঙ্গীকার স্বরূপ। যেখানে সত্য- নিষ্ঠা,মানুষ্যত্ববোধ, চেতনা, দৃঢ়তা ও জ্ঞানের প্রবণতা নেই; সেখানে আত্ম- বিশ্বাসের স্থায়িত্ব নেই ।
যদি ব্যক্তি জীবনে কখনও আত্ম-বিশ্বাসের অভাব দেখা দেয়, তখন দ্বিধা- সংকোচ আর নিরাশার চিহ্নই ফুটে ওঠে। আর এ কারণেই জীবনের প্রতিষ্ঠা ব্যাহত হয়। জীবন হয় বাধার সম্মুখীন। পদে পদে বিপদের হাতছানি ব্যক্তি জীবনকে অতিষ্ট করে তোলে। নিরাশার রাহু থেকে মুক্তি হয় না কখনও। আপনি কি নিজেকে আত্ম-বিশ্বাসী বলে মনে করেন? আসলে আত্ম-বিশ্বাস কি সে সম্পর্কে আপনি কতটুকু অবগত।
আত্ম-বিশ্বাস থেকে আত্ম-বিশ্বাসীর জন্ম। যার সহজ বাংলা হচ্ছে-নিজের প্রতি আস্থা বা বিশ্বাস। আত্ম-বিশ্বাসী হতে হলে নানাবিধ গুণে গুণান্বিত হতে হয়। যার আত্ম-বিশ্বাস নেই, তার সফলতা অনিশ্চিত! আত্ম-বিশ্বাস মানুষকে আত্ম-শক্তিতে বলীয়ান করে; আত্ম-নির্ভরশীলতা দান করে। ইংরেজীতে একটি বাক্য আছে “Selfhelp is the best help” অর্থাৎ আত্ম- নির্ভরশীলতাই সর্বাপেক্ষা বড় সাহায্য। একজন মানুষকে যথাযথ সম্মানের সাথে প্রকৃত মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকতে হলে তাকে আত্ম-নির্ভরশীল হতে হবে। আত্ম-বিশ্বাস ব্যতীত জীবনে সফলতা আসবে না আর জীবনে সফলতা না এলে আপনি কখনও আত্ম-নির্ভরশীল হতে পারবেন না। পরের করুণা ও সাহায্য নিয়ে বেঁচে থাকায় কোন আত্ম-সম্মান ও আত্ম-মর্যাদা নেই। তাই আপনাকে আত্ম-নির্ভরশীল হতে হবে। তবেই আপনি হতে পারবেন স্বাধীন ব্যক্তিত্বের অধিকারী।
কজে-কর্মে স্বাচ্ছন্দ্য ও দৃঢ় চেতনাবোধ আপনার জীবনের গতিকে অসম্ভব গতিশীল করে তুলবে। আপনি বিজয়ীর আসনে নিজেকে সমাসীন করতে পারবেন অনায়াসেই । মানব জীবন একটি সংগ্রাম ও প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র। তাই এ জীবন সংগ্রামে জয়যুক্ত হওয়ার জন্য প্রয়োজন আত্ম-বিশ্বাস। আত্ম-বিশ্বাস আসে আপনার কর্মপ্রেরণার উৎস থেকে। আত্ম- বিশ্বাসের জন্য প্রস্তুতির গুরুত্ব অপরিসীম। উদ্দেশ্য + পরিকল্পনা + স্বপ্ন+ অনুশীলন+ধৈয্য+আত্ম-বিশ্বাস=ফলাফল। এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন আত্ম-বিশ্বাসের জন্ম কীভাবে হয়ে থাকে ।
আপনার উদ্দেশ্য হবে ব্যর্থতাকে প্রতিহত করার অদম্য চেতনা যা আপনাকে কর্মোদ্দীপনার সাথে কাজে অগ্রসর হওয়ার জন্য সীমাহীন শক্তি যোগাবে । যাদের কর্মের প্রতি গভীর আগ্রহ নেই। যারা অধ্যবসায়ের প্রতি অনীহা প্রদর্শন করেন এবং কঠোর পরিশ্রমের জন্য দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন না । তারা কখনই আত্ম-বিশ্বাসী হতে পারেন না। আত্ম-বিশ্বাস আপনার সমস্ত কর্মশক্তির উৎস। এ শক্তির উপরই ব্যক্তির সফলতা নির্ভর করে। যদি আপনার দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে কর্মের সংযোগ না হয় তাহলে আপনি হবেন ভুল পথের পথিক। হতাশা ও দুশ্চিন্তার ফলে সাফল্যের সম্ভাবনাময় কাজও ব্যর্থতার মুখোমুখি হবে। আত্ম-বিশ্বাস অলৌকিক ঘটনার জন্ম দেয় না বরং অলৌকিক ফলাফল সৃষ্টি করে।
আমরা কাজ না করে অলসতার বশে হতাশা ও দুশ্চিন্তার জন্ম দেই । যখন আমরা আঘাতপ্রাপ্ত হই, তখন আমরা মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্থ হই আর তখনই আমরা নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করি। নিজেদেরকে অবিশ্বাস করি। আত্ম-বিশ্বাসহীনতায় ভুগি এবং আত্ম-গ্লানিতে ভেঙ্গে পড়ি। আমাদের এসব নেতিবাচক মনোভাবের পরিবর্তনের জন্য আত্ম-বিশ্বাসের পুনরুদ্ধার প্রয়োজন। এর জন্য আমাদের কাজের প্রস্তুতি নিতে হবে। প্রস্তুতির অর্থ
পরিকল্পনা ও অনুশীলন এবং এই পরিকল্পনা ও অনুশীলনকে একটি স্থির লক্ষ্যের মাধ্যমে অগ্রসর হওয়ার কর্মপ্রেরণার নাম প্রস্তুতি । বিজয়ীরা নিজেদের এ প্রস্তুতির উপযুক্ত করে তৈরী করেন। এবং ইতিবাচক পদক্ষেপ দ্বারা জীবনকে পরিপূর্ণ করার সংগ্রামে লিপ্ত হন।
* আত্ম-বিশ্বাস শুধু ব্যক্তি নয় বরং সমাজ, ধর্ম ও রাষ্ট্রীয় উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করে। কারণ আত্ম-বিশ্বাসই আত্ম-নির্ভরশীলতা সৃষ্টি করে। আর ব্যক্তি জীবনে আত্ম-নির্ভরশীলতার যেমন প্রয়োজন তেমনি জাতীয় জীবনেও আত্ম- নির্ভরশীলতার বিশেষ প্রয়োজন। অন্যথায় শুধু ব্যক্তিই নয় বরং কোন জাতির পক্ষেই জাতীয় উন্নয়ন সম্ভব নয়। ‘যে জাতি যত বেশি পরনির্ভর, সে জাতি তত বেশি অনুন্নত। ব্যক্তির ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নয়।
পরনির্ভরশীলতা কোন ব্যক্তি ও জাতির জন্য কখনই মঙ্গলজনক নয় । তাই আত্ম-নির্ভরশীল হওয়ার জন্য চাই সীমাহীন আত্ম-বিশ্বাস। আর আত্ম- বিশ্বাসকে সুদৃঢ় করতে চাই কঠোর পরিশ্রম ও অধ্যবসায়। আমাদের আত্ম- নির্ভরশীলতার প্রধান অন্তরায় হচ্ছে আমরা অলস। আলস্য পরিহার করে যতদিন পর্যন্ত না আমরা পরিশ্রমী হওয়ার সাধনায় যোগ দেব ততদিন পর্যন্ত আমরা আত্ম-বিশ্বাসী ও আত্ম-নির্ভরশীলতার মুখ দেখব না ।
আলস্য ও পরনির্ভরশীলতা এসব আমাদের পরম শত্রু । আর অলস ব্যক্তি জাতির শত্রু। কারণ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অলস ব্যক্তির সমষ্টিই একটি পুরো জাতিকে অলস বানাতে যথেষ্ট। আমাদের বাঙ্গালী জাতিতে মূলত তাই হয়েছে । আমরা এখনও পরনির্ভরশীল। আমরা অনেক সময় কাজের মধ্যে আত্ম-মর্যাদার হিসেব কষি। কাজকে বিভিন্ন জাত ও গোত্রের মধ্যে বিভাজন করি। যতদিন পর্যন্ত আমরা শ্রমের মর্যাদাকে শ্রমের মাঝেই বিভাজন করতে না শিখব ততদিন পর্যন্ত আমাদের ব্যক্তিক ও সমষ্টিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে না ।
বর্তমান প্রতিযোগিতার বিশ্বেও আমাদের জাতিতে আলস্যের সংখ্যাই সর্বাধিক। আমাদের মাঝে অনেকেই আত্ম-নির্ভরশীলতার স্বপ্ন দেখলেও আমরা স্বীয় জ্ঞান-বুদ্ধি খাটিয়ে পরিশ্রমলব্ধ আয়ের সুপরিকল্পিত ব্যবহার করতে পারিনি। ব্যক্তিক উন্নয়ন ব্যাহত হওয়ার কারণেই আমাদের জাতীয় উন্নয়ন সম্ভব হচ্ছে না। আমাদের জ্ঞান ও পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজের গতিকে ক্রিয়াশীল না করার দরুণ আমরা বিশ্ব ব্যবস্থায় মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে ব্যর্থ। আমাদের আত্ম-বিশ্বাসের অভাবে আমরা ধুকে ধুকে মার খাচ্ছি। আর ব্যর্থতা নয়, নয় কোন হতাশার হাতছানি, আত্ম-বিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে সাফল্যের সৌধ নির্মাণ করাই আমাদের দায়িত্ব মনে করি
শুভবুদ্ধির পথ অবলম্বন করুন
“কর্ম ছাড়া পৃথিবীতে কোন মানুষ নেই; যার কর্ম নেই; তার বেঁচে থাকার স্বপ্ন শিকড়বিহীন বৃক্ষের সমতুল্য।’ কাজ আপনাকে করতেই হবে। তা যে কোন কাজই হোক না কেন; আপনার বেঁচে থাকার উপায়ই হচ্ছে কাজ । কিন্তু অভিজ্ঞতা, মেধা ও শ্রমকে যদি যথাযথভাবে ব্যবহার করা না হয় তাহলে উপরন্তু আপনার কাজ তো জুটবেই না বরং যে কাজগুলো সদ্য সমাপ্ত করেছেন সেগুলোও নেতিবাচক ফলাফল প্রদর্শন করবে।
এর একটি উপযুক্ত উদাহরণ দেয়া যেতে পারে, যেমন আপনি একজন ছাত্র । প্রথম শ্রেণী থেকে দ্বিতীয় শ্রেণী, দ্বিতীয় শ্রেণী থেকে তৃতীয় শ্রেণী এভাবে নবম-দশম শ্রেণী পর্যন্ত সুদীর্ঘ দশটি বছর ইনিয়ে-বিনিয়ে কাটিয়ে দিয়েছেন। এবার সামনেই এস. এস. সি. পরীক্ষা। আপনি সব শ্রেণীই কোন রকমে অতিক্রম করেছেন। কিন্তু আপনার যে দশটি বছর ব্যয় হয়েছে, সে সময়গুলোকে শেখা, অভিজ্ঞতা, মেধা ও শ্রমের সমন্বয় ও যথাযথ ব্যবহার করতে পারেননি। এখন দশম শ্রেণীতে এসে আপনার অভিজ্ঞতায় যেমন ভাটা পড়েছে তেমনি মেধা ও শ্রমের ব্যবহারও সঠিকভাবে হয়নি বিধায় আপনি দশটি বছর ব্যয় করেও কিছুই অর্জন করতে পারেননি। ফলে এস. এস. সি পরীক্ষায় কৃতকার্য হওয়ার প্রতি আপনার আত্ম-বিশ্বাসের সীমাহীন ঘাটতি নানা রকম দুশ্চিন্তা ও হতাশার জন্ম দিয়েছে।
এজন্য আপনি বিনা হিসেবে ফেল তথা অকৃতকার্য হবেন তাতে কোন প্রকার সন্দেহ নেই। এখানে লেখা পড়াও প্রতিটি ছাত্রের জন্য কাজ স্বরূপ। এটা জীবন গঠনের কাজ। কিন্তু এর পাশাপাশি আমাদের আরও জীবিকামুখি নানা কাজে আত্ম-নিয়োগ করতে হয়। সব সময় আমরা কাজকে মূল্যায়ন করব। কাজকে কখনও ছোট বড় জাত ভেদে বিভাজন করব না। তাহলে আমরা কখনও নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারব না ।
কাজ যদি মনোযোগের সহিত সম্পাদন না হয় তাহলে সে কাজ যেমন সুন্দর ও মজবুত হয় না। তেমনি তার ফলাফলও আশানুরূপ হয় না। যে কাজগুলো জীবন গঠনে একান্ত সহায়ক সে কাজগুলোতে মনোযোগের সংযোগ, অভিজ্ঞতার সঞ্চার, মেধায় ব্যবহার, শ্রমের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, কঠোর অনুশীলন ও দৃঢ় সংকল্প এবং সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য স্থির করা না হলে তাতে ব্যর্থতার শতভাগ প্রভাব পড়তে বাধ্য, এটা পরীক্ষিত সত্যি।
উপরোক্ত কাজগুলোর পেশা যেমন- ছাত্র অথবা শিক্ষার্থী, গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকুরীজীবি, সৃজনশীল ও মননশীল কর্মে উদ্যোগী ও সর্বোপরি আত্ম-উন্নয়ন কর্মী ।
শুধু শিক্ষা ও শিক্ষার্থীই যে বই পড়বে, জ্ঞানার্জন করবে ও কোন কিছু শিখবে তা নয় আমাদের জীবনকে জানতে, গড়তে এবং জীবনের গতি-প্রকৃতির অবস্থা বুঝে সিদ্ধান্ত নিতে জীবনমুখি জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার সঞ্চার করতে অবশ্যই আমাদেরকে জ্ঞান ও গবেষণাধর্মী বইয়ের সাহায্য নিতে হবে। নানা বইয়ে নানা অভিজ্ঞতার ব্যাপ্তি রয়েছে। আমরা যদি তা আহরণ করে আমাদের কর্মক্ষেত্রে যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারি। সুন্দর ও বাস্তবমুখি জীবন গঠনে সহায়ক উপদেশগুলোকে যদি আমরা জীবনের প্রয়োজনে কাজে লাগাতে পারি তাহলে আমরা অবশ্যই সফল হতে পারব। বিপদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজেকে স্থির লক্ষ্যস্থলে গমনের জন্য অবিচল ও অটল ভাবে দৃঢ় সংকল্পের সাথে পরিচালিত করতে পারব। এই ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরীতে একান্ত সহায়ক বই-ই আমাদের জীবন গঠনে সহায়ক ।
আপনি যেমন আমার এই বই পড়ছেন, তেমনি আমার লেখা বইগুলোও আপনাকে এ ব্যাপারে জীবন গঠনে যথেষ্ট সহায়তা করবে। আপনাকে প্রতি নিয়তই কর্মের প্রতি গতিশীল করে তুলবে। কাজ চালিয়ে যাওয়ার অদম্য চেতনাবোধ আপনাকে সাফল্যের সিংহ দ্বারে নিয়ে যাবে। এজন্য আপনি আমার লেখা ‘হাউ টু সাকসেস্ ইন লাইফ‘ অর্থাৎ কীভাবে জীবনে সফল হওয়া যায় এবং ‘জীবন মানেই কাজ’ বইটি পড়ুন ।
আপনি যে কোন ভাল লেখকের ভাল বইয়ের পাশাপাশি আমার লেখা আত্মোন্নয়নমূলক বইগুলি সংগ্রহ করে পড়তে পারেন। আমি আপনাদেরকে নানা বিষয়ে আমার সাধ্যমত সমাধান দেয়ার জন্য দীর্ঘদিন যাবৎ গবেষণাধর্মী বই প্রকাশ করে আসছি। অনেকেই আমার লেখা বইগুলো পড়ে উপকৃত হয়েছেন। শুধু এর একটি উদাহরণ দিতে চাই ।
আমি একদিন নীল ক্ষেতে যাচ্ছি। ইত্তেফাকের মোড় থেকে বাসে উঠলাম । মতিঝিল শাপলা চত্ত্বরে এসে কয়েকজন ছাত্র বাসে উঠল । ওরা সবাই এবং আমি পেছনের আসনে বসা। আমার হাতে অনেকগুলো বই দেখে সব ছাত্রই বার বার বইগুলোর দিকে তাকাচ্ছিল। ওরা সবাই বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী নটর ডেম কলেজের ছাত্র। সম্ভবত ফার্স্ট ইয়ারের হবে।
এক ছাত্র আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, “বইয়ের ব্যবসা করেন নিশ্চয়ই।’ আমি হেসে বললাম, ‘ঠিক তাই।’ সে বলল, ‘অনেকগুলো বই দেখছিতো সেজন্য। তাছাড়া একই লেখকের এতগুলো বই দেখেও মনে হয় আপনার বইয়ের দোকান আছে। এবার একটু মুচকি হেসে নিরব থাকলাম। একজন ছাত্র আমার হাত থেকে ‘হাউ টু সার্ক্সীড় ইন লাইফ’ নামের বইটা নিয়ে বলল, “এই বইটা পড়ার পর থেকে আমি আড্ডা ছেড়ে দিয়েছি।” আমি বললাম, “কেন?”
সে বলল, বইটায় যা লেখা আছে শিরোনামটা হল “কীভাবে আড্ডা দেবেন?” পর্বটি আমার কাছে চমৎকার লেগেছে তবে ব্যাখ্যাটা খুবই সংক্ষিপ্ত । তার কথা শুনে অন্যান্য বন্ধুরা আমার হাত থেকে আরও দু’টি বই নিয়ে নাড়াচাড়া করে বিক্রির দাম জিজ্ঞেস করল, তার মধ্যে সবার,সেরা প্রছেন্দের বই হল ‘হাউ টু বি এ গুড স্টুডেন্ট’ অর্থাৎ কীভাবে ভালো ছাত্র হবেন এবং ‘জীবন মানেই কাজ’
বই দু’টি ওদের সকলের দৃষ্টি কেড়ে নিল । আমি যে লেখক সে কথাটি গোপন রাখলাম। বললাম এটা নীলক্ষেত, নিউ মার্কেট ও কাছাকাছি পুরানা পল্টন মোড়ে পাওয়া যাবে। পূর্বের ছাত্রটি আবার বলল, বইটি ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমার সামনে পরীক্ষা তাই কেবল হাউ টু সাসীড় ইন লাইফের কীভাবে আড্ডা দেবেন পর্বটি পড়েছি। এই পর্বটিই আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করছে। পরীক্ষা শেষে পুরোটাই শেষ করব এবং গুড স্টুডেন্ট বইটিও নিয়মিত পড়ব। অন্যান্য বন্ধুরা বইটি কেনার জন্য আমাকে বার বার বিচিত্র দাম বলল, আমি বললাম, এক দোকানে নিয়ে যাচ্ছি। আমি প্রকাশনের লোক, বইয়ের অর্ডার ছিল ।
নটর ডেম কলেজের ছাত্রটি বলল, এই লেখকের অন্যান্য বইগুলি আমার অসম্ভব উপকার করেছে। তবে সব লাইব্রেরীতে পাওয়া যায় না বলে বই সংগ্রহ করতে সমস্যা হয়। তখনও আমি লেখকের পরিচয় গোপন করলাম। পথে ছাত্ররা বিদায় নিল। আমি নীল ক্ষেতে এসে নামলাম ।
আমি লেখকের পরিচয় দিলে হয়তো তাদের বিশ্বাস করতে কষ্ট হত। কারণ আমি লেখক হয়ে লাইব্রেরীর জন্য বই বহন করছি এটা হয়তো অনেকেই বিশ্বাস করবেন না। আর তা ছাড়া আমার একটা উদ্দেশ্য ছিল তা হল। আমার সম্পর্কে পাঠকের অভিমত যাচাই করা। ছাত্রটির কথাগুলো আমাকে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য সীমাহীন চেতনাশক্তির অধিকারী করে তুলল। আমি আমার লেখার স্বীকৃতি পেলাম। এ ভাবনাটাই আমাকে নিত্য- নতুন ভাবনা, প্রেরণা সঞ্চার করতে লাগল। প্রশংসা মানুষকে কত অনুপ্রাণিত করতে পারে তার জ্বলন্ত প্রমাণ আমি হাতে-নাতেই পেয়ে গেলাম।
আমি মানুষ ও তার জীবন নিয়ে ভাবতে পছন্দ করি এবং এখানে অদ্ভুত রহস্যের গন্ধ পাই। এ রহস্য সুদূর প্রসারী, কখনও হাসি, কখনও কান্না, কখনও আনন্দ, কখনও বেদনা, কত যে রূপ, রং, ঢং এই জীবনের ব্যাপ্তিতে তার কোন ইয়াত্তা নেই। আবার উত্থান-পতন, সফলতা-ব্যর্থতা আমাকে বার বার ভাবিয়ে তোলে। এত রহস্য, এত কৌতূকবোধ বোধহয় অন্য কোন জীব বৈচিত্র্যের মাঝে স্রষ্টা দেননি। এত সুন্দর করে স্রষ্টা কোন সৃষ্টিকেই সৃষ্টি করেননি। তাইতো মানব কূলের স্থান সকল সৃষ্টির উর্দ্ধে ‘আশরাফুল মাখলুকাত তথা সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে পৃথিবীতে মানব জাতির আগমন।
৯. মানুষ সর্বদাই এ বৈচিত্র্যময় জীবন থেকে সুখের সন্ধান করে। সাফল্যের পথে নিজেকে পরিচালিত করার ইচ্ছা ব্যক্ত করে কিন্তু সাফল্য কী সহজেই হাতছানি দেয়? সাফল্যের জন্য চাই উপযুক্ত পরিবেশ, প্রস্তুতি, উদ্দেশ্য প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায়। আমি এতক্ষণ যে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করলাম তার মূলই হচ্ছে মানুষ। মানব জীবন। যদি আবারও আপনাকে একটি প্রশ্নই করে বসি যে আপনি কে? যদিও এর বহু উত্তর হতে পারে তবুও আপনি হয়ত সহজেই বলবেন, আমার প্রথম পরিচয় ‘আমি একজন মানুষ।’
আপনি কি সুস্থ সবল মানুষ?
আপনার দু’টি হাত, দু’টি পা, দু’টি চোখ, দু’টি কান অর্থাৎ শরীরের প্রত্যেকটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গই কি পূর্ণাঙ্গ? যদি এর উত্তর হ্যাঁ হয়; তাহলে আপনিই জগতের সবচাইতে সুখি। আপনার চারিদিকে তাকালে হয়ত চোখ পড়বে; বিকলাঙ্গ, অন্ধসহ নানান প্রকৃতির অঙ্গহীন মানুষ। তারাতো আপনার মতই বাঁচতে চায়। আর এ অধিকারটুকু আদায় করতে প্রতিনিয়তই জীবন যুদ্ধে লিপ্ত হতে হচ্ছে তাদেরকে। তাদের এ যুদ্ধ বেঁচে থাকার যুদ্ধ। জীবন সংগ্রামে ঘাত- প্রতিঘাতকে অতিক্রম করে টিকে থাকার যুদ্ধ।
ফিগার যে অন্ধ সে দেখতে পায় না। যে পঙ্গু সে হাঁটতে পারে না, যে বধির সে শুনতে ও বলতে পারে না। এভাবে বহু প্রতিবন্ধী মানুষ পৃথিবীতে আছে। আবার কারও অঢেল সম্পদ আছে, কিন্তু সে আপনার মত সুস্থ সবল নয়। আসলে শুধু অর্থ-সম্পদই মানুষকে সুখি করতে পারে না। যে মানুষটি দৌহিকভাবে সুস্থ ও সবল এবং উন্নত মনের অধিকারী সেই প্রকৃত সুখি এবং সাফল্য অর্জনে সক্ষম।
একদিন এক বন্ধুর সাথে একটি প্রাইভেট ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে গেলাম । সেখানে দেখতে পেলাম একজন অফিসার অঙ্গহীন । অর্থাৎ তার এক হাত অর্ধেক নেই আর এক হাত কব্জি পর্যন্ত বাকা। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা । যুদ্ধের সময় হানাদারদের গুলিতে তার এক হাত কেটে ফেলা হয় আর এক হাতের কব্জির ভেতরে গুলি প্রবেশ করে তবুও তিনি নির্বিগ্নে কাজ করে যাচ্ছেন। আমার কাছে মনে হচ্ছে তার লিখতে খুবই কষ্ট হচ্ছে। অথচ চোখের সামনে দিস্তা দিস্তা কাগজে তার লেখার দৃশ্য আমাকে মুগ্ধ করেছে। এ থেকে বুঝলাম শুধু বাঁচার তাগিদে সমাজের অন্য সব সুস্থ সবল মানুষের মত তাকে অফিস করতে হচ্ছে, রীতিমত কাজ করতে হচ্ছে। অথচ তিনি যে কত কৌশলে হাত ঘুরিয়ে কাজ করছেন। তা দেখলে হয়তো আপনারই মায়া হবে ।
তাহলে এবার ভাবুন তো। জীবনে চলার পথে তাকে আরও কত কষ্ট করতে হচ্ছে। এবার হয়তো আপনাকে বুঝাতে পেরেছি যে কর্ম ছাড়া পৃথিবীতে কোন মানুষ থাকতে পারে না। যদি থাকে তবে তাকে অপরের দয়ায় মাথা নীচু করে বাঁচতে হবে। সাফল্য ব্যর্থতার কোন অনুভূতিই তার থাকতে পারে না ।
মহান স্রষ্টা ধর্ম-গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন প্রতিটি মুহূর্তে মানুষকে পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হবে। অর্থাৎ আপনার সামনে হাজার হাজার প্রতিযোগী তাদের অতিক্রম করে কর্মক্ষেত্রে নিজের মেধা ও শ্রমের সমন্বয় করতে পারলেই আপনি সফল ।
যদি আপনাকে ছাত্র মনে করি। তাহলে আপনার কাজ হবে নিয়মিত অধ্যয়ন করা। এটা আপনার পেশার জন্য প্রধান কাজ। আর মানুষ হিসেবে প্রত্যেকটি মানুষের জীবনের তিনটি কাল বা পর্যায় রয়েছে, বাল্যকাল, যৌবনকাল ও শেষ কাল বা বৃদ্ধকাল। এই তিন কালের মধ্যে দু’টি কালের সাথে মানুষকে যুদ্ধ করে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে হয় । আর তৃতীয় কালটা ঐ দু’টি কালের সফলতার উপর নির্ভরশীল। বাল্যকাল ও যৌবন কালটাই আপনার জন্য তথা প্রত্যেকটি মানুষের ক্ষেত্রেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কাজেই এ দু’টি কালে যারা বিশেষ করে যৌবনকালে যারা সময় ও শ্রমকে যথাযথ ব্যবহার করে জীবন যুদ্ধে জয়ী হতে পারেন। তারাই বাকী জীবনে সফলতা ভোগ করেন ।
মানুষের জীবন সংক্ষিপ্ত হলেও এর ক্ষেত্রে বিশাল। এখানে মানুষ তার আপন কর্মের দ্বারা আজীবন বেঁচে থাকেন । পৃথিবী সৃষ্টি লগ্ন থেকে কোটি কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। শুধুমাত্র হাতে গোনা কয়েকজনের নাম আজও মানুষ ভুলতে পারেনি। তাদের নাম সকল মানুষের হৃদয়ে কৌতূহলের বিস্ময় হয়ে আছে। তাদের সৃষ্টি-কর্ম যুগ যুগ ধরে মানুষের মনে আত্ম-জিজ্ঞাসার সন্ধান দিচ্ছে
ইতিহাসে, সাহিত্যে, বিজ্ঞানে, ধর্ম-দর্শনে, মানব মনের মননশীলতায়, মানব সেবায় ইত্যাদি নানান বিষয়ে তাঁদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে এবং যুগ যুগ ধরে থাকবে । এর কারণ তারা কঠোর শ্রমের মাধ্যমে সময়কে যথাযথ ব্যবহার করে জীবনে সফলতা লাভ করেছেন যা ইতিহাসে তাঁদের স্থান করে দিয়েছে। মানুষ শ্রদ্ধাভরে আজও স্মরণ করছেন তাঁদেরকে। অথচ শত শত বছর পূর্বেই তাঁরা পৃথিবী ত্যাগ করেছেন। মহামাবন হযরত মুহাম্মদ (দঃ), মহাবিজ্ঞানী নিউটন, আইনস্টাইন, সক্রেটিস, প্লেটো, এ্যারিস্টটল, রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল ইসলাম ও বঙ্গবন্ধু প্রমুখগণকে আজীবন মানুষ তাদের কর্মের জন্য মনে রাখবেন। তাঁরা বিলাস বহুল জীবন তুচ্ছ করে অক্লান্ত পরিশ্রমের দ্বারা নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার অধ্যবসায়ে আত্ম-নিয়োগ করেছিলেন এবং স্বর্ণশিখরে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন ।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ নিজেই ঘোষণা দিচ্ছেন- لیس للانسان الا ما سعی “লাইসা লিল ইনসানে ইল্লা মা সা ‘আ।” অর্থাৎ মানুষের জন্য শ্রম ব্যতিরেকে কিছুই নেই। তাই জীবনে সফলতা লাভ একমাত্র শ্রমের দ্বারাই সম্ভব। জ্ঞানীর জ্ঞান ভাণ্ডার, ধনীর ধন, বিজ্ঞানীর আশ্চর্য আবিস্কার, নিজেকে মেধাবী করে তোলা। ধর্ম সাধকের আত্মোপলব্ধি, যোদ্ধার যুদ্ধে জয়লাভ, সবকিছুই শ্রমের দ্বারা অর্জিত। মানব জীবনের সকল উন্নতির মূল চাবিকাঠিই হচ্ছে- শ্রম, সুতরাং শ্রম ব্যতীত উন্নতির আশা করা আর কল্পনার মাঝে নীল আকাশ ভ্রমণ করা সমান কথা ।
একটি প্রবাদ আছে যে, “বসে খেলে রাজার বিশাল ভাণ্ডারও শূন্য হয়ে যায়।” সুতরাং শ্রমের গুরুত্বকে অস্বীকার করার ক্ষমতা আল্লাহ তা’আলা মানুষকে দেননি। তাই তিনি পবিত্র কোরআনে বলেছেন, “যে নিজেকে সাহায্য করে, স্বয়ং আল্লাহ তাকে সাহায্য করেন।” ইংরেজিতে যে বাক্যটি আরও গুরুত্ব পেয়ে থাকে তা হল- God helps Those who help them- selves. শ্রমের প্রতি ঔদাসীন্যতায় অতীতে বহু জাতির পতন হয়েছে । এ জন্যেই এক মনীষী বলেছেন, “তোমার ক্ষুদ্র জীবনটাকে কঠোর পরিশ্রমের দ্বারা যত পার স্বার্থক করে তোল।”
শ্রম ব্যতীত প্রতিভাবান হতে চাওয়া, অরণ্যে রোদনের সামিল, কারণ নিচের বাক্যটি থেকে জানতে পারি-Industry is the mother of goodluck অর্থাৎ পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসূতি। এ কথা নিঃসন্দেহেই বলা যায় পরিশ্রমই সৌভাগ্যের জন্ম দেয়। ভাগ্য বলে যে কথাটি চালু আছে তা কেবল পরিশ্রমের ফলাফলের নাম। ভাগ্য বলে কিছু নেই তা নয়। ভাগ্য বলে যা কিছু আছে তা পরিশ্রমের দ্বারাই তৈরী হয়। কঠোর পরিশ্রম যে অলৌকিক ফলাফলের জন্ম দেয় তার নামই সৌভাগ্য। সুতরাং সৌভাগ্যের জন্ম কঠোর পরিশ্রমের ফলাফল থেকেই।
বিখ্যাত বিজ্ঞানী নিউটন বলেছিলেন, “আমার আবিস্কারের কারণ প্রতিভা নয়, বহু বছরের চিন্তাশীলতা ও কঠোর পরিশ্রমের ফলে দুরূহ তত্ত্বগুলোর রহস্য আমি ধরতে পেরেছি, অস্পষ্টতা থেকে ক্রমে ক্রমে স্পষ্টতার দিকে উপস্থিত হয়েছি।” ডালটন এক বিবৃতিতে স্পষ্ট ভাষায় প্রকাশ করেছেন প্রতিভাবান বলে, কিন্তু আমি পরিশ্রম ছাড়া কিছুই জানি না।” লোকে আমাকে পৃথিবীতে যারাই সফল হয়েছেন তাদের জীবনী পর্যালোচনা করলে এভাবে কঠোর শ্রমের সীমাহীন নজীর চোখে পড়ে।
সুতরাং শ্রমের প্রতি অবহেলায় বা সামান্য ত্রুটির কারণে, ব্যর্থ হয়ে পিছপা হওয়াটা, বুদ্ধিমানের তথা শুভবুদ্ধির পরিচয় নয়; কথায় আছে একবার না পারিলে দেখ শতবার। ইংরেজিতে আছে “Failurs is the pillar of success.” অর্থাৎ যিনি বিফলতার তিক্ত অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে অধ্যবসায়ের সাথে কার্যে অগ্রসর হন, সফলতা তার জন্য সুনিশ্চিত ।
এর একটি চমৎকার উদাহরণ দেয়া যায়। ইউজার স্কটল্যাণ্ডের রাজা রবার্ট ব্রুস; ইংল্যাণ্ডের রাজা এ্যাডওয়ার্ডের সাথে পর পর ছয়বার যুদ্ধে পরাজিত হয়ে, শেষে নিরাশ মনে বহুদিন জঙ্গলে ঘুরছিলেন। হঠাৎ একদিন তার চোখে পড়ে একটি মাকড়সাকে। মাকড়সাটি পরস্পর দু’টি কড়িকাঠে সূতো জড়াতে চেষ্টা করছে, কিন্তু বার বার ব্যর্থ হচ্ছে। অবশেষে সপ্তমবার সে সূতো জড়াতে সক্ষম হল। মাকড়সার লক্ষ্য স্থলে সফল হওয়ার দৃঢ় সংকল্প দেখে রাজা অদম্য উৎসাহ খুঁজে পেলেন। গভীর আত্ম-শক্তিতে বলীয়ান হয়ে অসীম উৎসাহে দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে সপ্তম ও শেষ বারের মত শত্রুরাজ্য আক্রমণ করে স্বদেশ উদ্ধার করলেন। এভাবেই তিনি যুদ্ধে জয়ী হলেন।
মঙ্গল গ্রহে পাড়ি জমানো, চাঁদে যাওয়া মানুষের কাছে একদিন কল্পনার বস্তু ছিল। কিন্তু মানুষ কঠোর শ্রমের দ্বারা গবেষণা ও বহু চেষ্টার মাধ্যমে এ অসম্ভব কল্পনার বস্তুটিকেও আজ সম্ভব করে তুলেছেন। এসবের মূলে রয়েছে তার দৃঢ় সংকল্প ও কঠোর অধ্যবসায়। আমরা যদি উন্নত বিশ্বের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাই কঠোর অধ্যবসায় ও দৃঢ় সংকল্পের সীমাহীন নজীর। যে জাতি অলস ও শ্রমবিমুখ সে জাতির সকল ব্যবস্থাই অনুন্নত।
যে শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড (Education is the back bone of a nation) সে শিক্ষাও দৃঢ় সংকল্প ও কঠোর অধ্যবসায়ের মাধ্যমে অর্জিত হয় । মানুষের এ শিক্ষা অর্জন শুরু হয় শিশু শ্রেণী থেকে। মানব জীবনের কালের মত এ শিক্ষা অর্জনেরও কাল বা পর্যায় আছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে যাকে বলা হয় (step) ধাপ বা স্তর। যেমন, স্কুল জীবন, কলেজ জীবন ও বিশ্ববিদ্যালয় জীবন । আর শিক্ষানীতিতে জাতীয়ভাবে যে স্তর বিন্যাস তা হলঃ প্রাথমিক স্তর, মাধ্যমিক স্তর ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তর। উপরোক্ত স্তরগুলো ব্যাখ্যা করলে আপনার শিক্ষাজীবনের ভিত্তি আসে তিনটি যথাঃ “Foundation of first life.” প্রাথমিক স্তর; “Foundation of second life.” মাধ্যমিক স্তর এবং Foundation of last life. উচ্চ মাধ্যমিক স্তর।
একজন শিক্ষার্থীকে অবশ্যই সফলতার সাথে সবগুলো স্তর অতিক্রম করতে হবে; তবেই তার শিক্ষাজীবনের ভিত্তি হবে মজবুত ও শক্তিশালী। এভাবেই তার জীবনে একের পর এক সফলতার দ্বার খুলে যাবে। এর ব্যতিক্রম হলে ব্যর্থতা তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকবে। পরীক্ষা পর্যন্ত শিক্ষার্থীকে ব্যর্থতা ডাকতে থাকবে। পরীক্ষা শেষ হলে ফলাফল পর্যন্ত তার ডাক অব্যাহত থাকবে। ফলাফল যখন ব্যর্থ হবে তখন আবার কর্মক্ষেত্রে ব্যর্থতা আলিঙ্গন করবে; এভাবে একের পর এক ব্যর্থতাও জীবনকে ঘ্রাস করে ফেলবে। এ মহা ঘ্রাস থেকে মুক্তি পেতে হলে Foundation of first life- এ যদি সময় না হয়; অর্থাৎ এ স্তরটি অতিক্রম হয়ে গেছে তাহলে মাধ্যমিক স্তরটিকে শক্ত করে ধরতে হবে।
এ স্তরে যেন অবশ্যই সফল হওয়া যায় যদি এ স্তরটিও পূর্বের ন্যায় ইনিয়ে বিনিয়ে অতিক্রম হয়ে যায় তবে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরটিই হতে পারে আপনার জীবনের শেষ ভিত্তি স্তর। যদি আপনি আপনার অতীত জীবনের ভুলগুলো ধরতে পেরে এ স্তরে এসে কঠোরভাবে অনুশীলনের মাধ্যমে সফল হতে চান অথবা সফলতার অগ্নি স্ফূলিঙ্গ বুকে নিয়ে দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত করেন এবং কঠোর সাধনায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। তাহলে আপনি অবশ্যই সফল হবেন। এভাবে পদক্ষেপ নিলে ব্যর্থতা কখনই আপনাকে হাতছানি দিয়ে ডাকবে না। বরং ব্যর্থতা আপনার শিক্ষা জীবন থেকে অনেক দূরে গিয়ে অবস্থান করবে। তখনই আপনি হবেন সফল।
প্রত্যেক স্তরের সফলতার উপর নির্ভর করে একজন ছাত্রের পদযাত্রা। স্কুল জীবন, কলেজ জীবন ও বিশ্ববিদ্যালয় জীবন, এক একটি স্তরই অভিজ্ঞতার এক একটি অধ্যায়। আর এসব অধ্যায়ের সমন্বয়ে পরিপূর্ণ শিক্ষা জীবন। যা মানব জীবনের সাথে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। ছাত্র জীবনের সাথে পরিবেশ ও পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার বেশ প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। এ জীবন সংযম আর অধ্যবসায়ের হাতিয়ার। প্রতিটি পদক্ষেপে সচেতনতা ও দৃঢ়তার আশ্রয় নিতে হয়।
১। স্কুল জীবনে সফলতা অর্জন করেও কেউ কলেজ জীবনে অবহেলার কারণে জীবনের গতিপথ হারিয়ে ফেলেন। আবার কালেজ জীবনে সফলতা অর্জন করেও অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে অবহেলার কারণে হতাশা ভোগ করেন। অতএব প্রত্যেকটি স্তরেই আপনাকে দৃঢ়তা ও অদম্য প্রেরণার মাধ্যমে অধ্যবসায়ে লিপ্ত হতে হবে। তবেই আপনার শিক্ষা জীবন সাফল্যে পরিপূর্ণতা লাভ করবে।
আবার অনেকের প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও তাকে কাজে লাগাতে না পারায় প্রতিভার অপমৃত্যু ঘটান। আবার কারও বিকাশের সুযোগ নেই। নানান ধরনের বাধার সম্মুখীন হয় ছাত্র জীবন। যা ভেদ করে লক্ষ্য স্থলে পৌঁছানোর দৃঢ় সংকল্পই সফলতার হাতছানি । প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও কিছু কিছু জীবন বিপন্ন হওয়ার অনেক নজীর চোখে পড়ে।
মানুষ স্বভাবতই সুখের সন্ধানী। সুখের নেশায় জগতের প্রত্যেকটি মানুষ ছুটাছুটি করছে। কিন্তু সুখের সন্ধান করতে হলে যে কঠোর শ্রম ও অধ্যবসায়ের অনুশীলন করতে হবে সে কথা অনেক মানুষই ভাবেন না। এ কারণেই জীবনে সবাই সুখি হতে পারেন না। সুখ একটি অলৌকিক প্রশান্তির নাম । প্রতিটি মানুষের মাঝে যে অলৌকিক অবচেতন বৃত্তির সীমাহীন শক্তি লুকিয়ে আছে, সে শক্তিকে আত্ম-শক্তিতে বলীয়ান করতে পারলেই আমরা সাফল্য অর্জনের পন্থা খুঁজে পাব । এ পন্থাকে যদি প্রতিটি মানুষ তার নিজের প্রয়োজনে সময় ও শ্রমকে একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের নিমিত্তে ব্যবহার করতে পারে তবেই সবাই সুখি হতে পারবে তাতে সন্দেহ নেই ।
মানুষ চায় দুঃখ কষ্টগুলোকে এড়িয়ে সুখকে জড়িয়ে ধরতে; সুখকে জড়িয়ে ধরতে হলে দুঃখ-কষ্টগুলোকে জয় করতে হবে তবেই আপনি জীবনে জয়ী হতে পারবেন। অথচ আমরা এসব কখনও ভেবে দেখি না । সুখ দেখার বস্তু নয়, অনুভব সাপেক্ষ। দুঃখ কষ্ট, ব্যথা-বেদনা যেমন কেউ দেখতে পায় না; তেমনি সুখও তাই। এ সবগুলোই অলৌকিক বৃত্তির অনুপম শক্তি । কিন্তু সুখ আর এসব পরস্পর বিপরীতমুখী ।
একদিকে দুঃখ-কষ্ট, ব্যথা-বেদনা অপরদিকে সুখ-আনন্দের স্বাচ্ছন্দ্যময় গতিধারা । প্রথমটির সাথে জীবনযুদ্ধে লিপ্ত হয়ে দ্বিতীয়টির শরণাপন্ন হতে হয় । তবেই আসে সুখ। প্রতিটি পদে পদে মানব জীবনকে এ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে হয়; আর এসবের মোকাবেলা করতে যে গুণগুলোর বিশেষ প্রয়োজন (পরিশ্রম+লক্ষ্য নির্ধারণ+কর্মপ্রচেষ্টা+দৃঢ় প্রত্যয়+স্বপ্ন)=ফলাফল ।
অধ্যবসায়ী ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী সকল ব্যক্তির উপরোক্ত গুণাবলী ছাড়াও সময় নিয়ন্ত্রণ অর্থাৎ সময়কে নিজের প্রয়োজনে যথাযথ ব্যবহার, কর্মোদ্দম-কর্মে তৎপর হওয়া, গভীর চিন্তাশীলতা চিন্তা-ভাবনা করে দৃঢ় সংকল্পের সহিত কাজ করা। পারিপার্শ্বিক জ্ঞান-দূরদর্শিতা ও চাতুর্যতা । লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ-নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌছার দৃঢ় প্রত্যয়ী হওয়া। অটল ও অবিচল ব্যক্তিত্বের অধিকারী হওয়া অর্থাৎ আপনি যা হওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষা পোষণ করবেন সে সাধনায় দৃঢ় সংকল্পের সাথে আত্ম-নিয়োগ করে অটল ও অবিচলতার সাথে সমস্ত বাধা অতিক্রম করে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌছার একাগ্রতা থাকতে হবে। এভাবে উচ্চাকাঙ্ক্ষীদের নানাবিধ গুণে গুণান্বিত হতে হয়; তবেই আপনি বিজয়ী “পথ পথিকের সৃষ্টি করে না, বরং পথিকই পথের স্রষ্টা ।
পথিক যেমন তার নিজের প্রয়োজনে পথের সৃষ্টি করে তেমনি সাফল্য কোন মানুষের সৃষ্টি করেনি বরং মানুষ তার নিজের প্রয়োজনে সুখি ও স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনের সন্ধান করেছে। সে ব্যর্থতার পরিবর্তে সাফল্যকে হাতছানি দিকে ডেকেছে। বিজয়ী হওয়ার জন্য সে নানা রকম অনুশীলনে যোগ দিয়েছে। তার এ প্রতিযোগিতা জীবনে জয়ী হওয়ার জন্যেই। এ জয়ী হওয়ার কামনায়, প্রতিযোগিতায় শীর্ষে থাকার জন্য সে কত কিছু আবিস্কার করতে সক্ষম হয়েছে। তার এ আবিস্কার তাকে অমরত্ব লাভের গৌরব এনে দিয়েছে।
পৃথিবীতে এসেছে পরিবর্তনের জোয়ার। আজ থেকে বিশ বছর আগের পৃথিবী এবং বর্তমানের পৃথিবী অনেক পার্থক্য। বিজ্ঞানের আশ্চর্য আবিস্কারের দ্বারা মানুষ তার জ্ঞান-বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে মানব সভ্যতার প্রভুত উন্নয়ন সাধন করেছে। আবিস্কারে সক্ষম হয়েছে নিত্য-নতুন সরঞ্জাম রেডিও, টেলিভিশন, সিনেমা, উড়োজাহাজ, ভিসিডি, কম্পিউটার, মোবাইল ফোন ও মহাশূন্যের যাত্রা পথের নানাবিধ তত্ত্বের ব্যবহার উদ্ভাবনের মাধ্যমে মানুষ প্রমাণ করেছে তার সীমাহীন জ্ঞান ও সাধনার ক্ষেত্র সুবিশাল ভাণ্ডার স্বরূপ। এ থেকেই প্রমাণিত হয় যে মানুষের কাছে অসাধ্য বলে কিছু নেই।
মানুষ হিসেবে আমাদের সকলেরই অনেক কিছু হতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে অনেক কিছু করতে; কিন্তু ইচ্ছে করে বসে থাকলেই চলবে না। উপায় খুঁজে বের করতে হবে। প্রথমে উপায় হলো (Objective set) অর্থাৎ উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা। তারপর স্বপ্ন কি তা প্রকাশ করা। স্বপ্নকে বাস্তবায়নের জন্য যা যা প্রয়োজন তার যথাযথ ব্যবহার এবং আকাঙ্ক্ষাকে গভীরভাবে কর্মে যুক্ত করা। আকাঙ্ক্ষা যখন সুগভীর হবে, কর্মের প্রতি যখন দৃঢ় প্রত্যয় থাকবে তখন সাফল্যের উপায় আপনি অবশ্যই খুঁজে পাবেন ।
আমাদের সমাজে এমন অনেক ছাত্রই আছেন; যাদের প্রচুর মেধা আছে কিন্তু চর্চা নেই, সে মেধাশক্তির কোন মূল্য নেই। কারণ চর্চার অভাবে একদিন সে মেধা শক্তির অপমৃত্যু ঘটবে । হঠাৎ স্মৃতির অতলে তলিয়ে যাবে। সহজেই তাকে আর খুঁজে আনা সম্ভব হবে না। এভাবেই বেশির ভাগ ছাত্ররা জীবনের নানা পরীক্ষায় অকৃতকার্য হন । নইলে স্রষ্টার অনুপম সৃষ্টি প্রতিটি মানব শিশুই জন্মের পর অসীম স্মৃতি শক্তি নিয়ে পৃথিবীতে পদার্পন করেন । পরিবেশ তাকে জড় বুদ্ধি, চালাক, চতুর ও সর্বোপরি বোকায় পরিণত করে। কেউ তার এ স্মৃতি শক্তির চর্চা করে ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ ও গতিশীল করেন আবার কেউ তার এ শক্তিকে অযত্নে ফেলে রেখে অপমৃত্যু ঘটান। এই হচ্ছে একটি ছাত্র তথা মানব জীবনের উত্থান পতনের হিসেব-নিকেশ ।
আবার কারও স্মৃতি শক্তি অপেক্ষাকৃত কম হলেও সময় ও শ্রমের সাথে জ্ঞানের সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে যে চর্চায় ব্রতী হন তাতেই তার স্মৃতি শক্তি গতিশীল হয়ে যায়। ফলে সে বিশেষ কৌশলের সন্ধান পায়। এ কৌশলেই তাকে কোন কিছু স্মৃতিতে স্থায়ী করতে সাহায্য করে থাকে। ফলে সে অনায়াসেই মেধাবী ও জীবনের প্রয়োজনে সাফল্যের দ্বার প্রান্তেপৌঁছতে সক্ষম হন।
উদাহরণস্বরূপ বলতে হয়, কামার যে লৌহ খণ্ডটি আগুনে পুড়িয়ে নতুন কোদাল তৈরী করেন; প্রথম অবস্থায় তা নতুন হলেও কিন্তু পুরাতন যে কোদালটি দু’বছর ধরে নিয়মিত ব্যবহৃত হচ্ছে তার তুলনায় অনেক কম ধারাল । কারণ সেটি ব্যবহৃত হতে হতে তীক্ষ্ণ ধারাল হয়েছে; তেমনি আপনার মেধা শক্তির চর্চা ও অধ্যবসায় যত বেশি হবে আপনার স্মৃতির ভাণ্ডার ও জীবনে সফলতা দ্রুত গতিশীল হবে যদি তা পরিশ্রমের সাথে সংযুক্ত হয়।
আপনি জীবনে যে কোন পেশা, যে কোন দিকও যদি বেছে নেন তবুও আপনাকে কঠোর শ্রম ও অধ্যবসায়ে যোগ দিতে হবে এর কোন বিকল্প নেই । কঠোর শ্রম ছাড়া কোন জাতিই জগতে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারেনি। ব্যক্তি জীবনে যখনই আপনি উদ্দেশ্য নির্ধারণ করবেন, কঠোর শ্রমে ব্রতী হবেন এবং অধ্যবসায়ে আত্মোনিয়োগ করবেন ঠিক তখনই আপনি সফলতার স্বর্ণশিখরে আরোহন করবেন ।
দৃঢ় সংকল্প
মনোবল ও দৃঢ় সংকল্পের অভাবে অতীতে অনেক প্রতিভার অপমৃত্যু ঘটেছে। রাজার রাজ্য, বীরের বীরত্ব ও বিজয়ীর বিজয় ম্লান হয়ে গেছে মনোবলের পরাজয়ের কাছে। দৃঢ়তা গভীর আত্ম-প্রত্যয়ের দ্বারা নিজেকে পর্বতের ন্যায় অটল ও অবিচল, ধ্রুবতারার মত স্থির এবং সীমাহীন আত্ম-বিশ্বাসী করে তুলে যা আপনার সাফল্যের পথকে সুগমে পরিণত করবে। দ্রুত সাফল্য অর্জনে নিজেকে সহায়ক করে তুলবে। আপনার লক্ষ্য হবে সামনের দিকে। ভাবতে হবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা।
কঠোর পরিশ্রম ও অসীম আগ্রহের সাথে এগিয়ে যেতে হবে কর্মক্ষেত্রে। সাফল্যের স্বপ্নীল দিগন্তে প্রবেশের ইচ্ছা পোষণ কারীদের কাছে পর্বতও নতী স্বীকারে বাধ্য। তাদের চিন্তা-চেতনায় কর্মে- অনুপ্রেরণায় থাকে শুধু স্বপ্ন বাস্তবায়নের পদক্ষেপগুলো-কীভাবে সাফল্যের ভিত্তি রচনা করা যাবে। পাহাড় সম বাধা তার ইচ্ছা শক্তির সামনে তুচ্ছ ম্লান হয়ে যায়। গভীর উৎসাহ-উদ্দীপনা তাকে তীব্র স্রোতস্বিনী নদীর মত নাব্যতা সঞ্চার করে-ফলে তার সাফল্যের সামনে সকল বাধাই তুচ্ছ হয়ে যায় ।
বিজয়ী সে হবেই। বিজয়ী তাকে হতেই হবে। বিজয়ের জন্য খেলা, বিজয়ী হওয়ার বাসনা নিয়েই আপনি মাঠে নেমেছেন। পরাজয়ের জন্য আপনি মাঠে নামেননি। জিততে আপনাকে হবেই। এ গভীর ইচ্ছা শক্তি যখন আপনার উচ্চাকাঙ্ক্ষায় দৃঢ় সংকল্প এনে দেবে। মনোবলকে চাঙ্গা করে তুলবে। তখনই আপনি সাফল্যের পথ খুঁজে পাবেন ।
আপনি কখনই অধ্যবসায়ের প্রতি অনিহা প্রদর্শন করবেন না। কখনও হাল ছাড়বেন না । যদি জীবনে সাফল্যের সম্ভাবনাময় ফুলকীর সাক্ষাৎ পেতে চান তাহলে বলুন “life is the race”. জীবনটাই প্রতিযোগিতা। সবাই আমার প্রতিযোগি । এ প্রতিযোগিতায় আমাকে জিততে হবেই। I must be success. আপনার এ মানসিকতাই অর্ধেক বিজয় ছিনিয়ে আনবে । তাহলে এবার মনে মনে সংকল্প করুন-Do or die – সাফল্যের জন্য চাই ‘জীবন পণ যুদ্ধ নয়তো মৃত্যুপণ প্রতিজ্ঞা; আপনার যে গুণগুলো সাফল্যের জন্য ইতিবাচক ফলাফল প্রদর্শন করবে তা হল- চেষ্টা, শ্রম, মেধা ও অনুশীল এবং গভীর মনোবলই আপনাকে সাফল্যের স্বর্গ রাজ্যের সন্ধান দেবে। ভেতরের সীমাহীন শক্তি আপনাকে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে অদ্ভুত প্রেরণার যোগান দেবে।
আপনার অভিজ্ঞতা, মেধা, শ্রম এবং উদ্দেশ্য যদি এক যোগে প্রয়োগ করার প্রত্যয় দৃঢ়ভাবে আপনার মনে সংকল্প জাগায় তবে সকল কাজে অসীম গতি সঞ্চারিত হবে সফলতা আপনাকে হাতছানি দিকে ডাকবে। সাফল্য অর্জনে যে গুণগুলো আপনাকে একান্ত ভাবে সহায়তা করবে তা হল; অধ্যবসায়/অনুশীলন
সংকল্প
উচ্চাকাঙ্ক্ষা মনোভাবের পরিবর্তন (ইতিবাচক মনোভাব)
ইতিবাচক চিন্তা-চেতনা (Think positive)
আত্ম-বিশ্বাস (Self confidence)
আপনার প্রতিটি কাজে ইতিবাচক আত্ম-বিশ্বাসী প্রত্যয়যুক্ত শব্দের ব্যবহার থাকতে হবে যেমন- Yes, of course, sure, certainly, Definitely শব্দগুলোকে প্রয়োজনে নিজেকে আত্ম-বিশ্বাসী করে তুলতে ব্যবহার করুন। অথবা সব সময় আপনার চোখের সামনে Replace করুন। দেখবেন আপনার ভাবনায় সব সময় ইতিবাচক চিন্তা-চেতনার জোয়ার বইছে। এবার নিজের আত্ম-বিশ্লেষণ করুন; আপনি আগে আপনার আমিত্বের গতি- প্রকৃতিকে জানুন। বুঝে নিন আপনার মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ্য অর্জনে কতটুকু গতিশীল। সংগ্রাম ছাড়া কেউ জীবনে জয়ী হতে পারেনি।
তাই জীবন সংগ্রামে লিপ্ত হয়ে একটি জিনিস আশা করতে হবে তা হল জয়ের জন্য সংগ্রাম (Success for struggle in life)। আপনার সাফল্যের অনুভূতি আসবে আপনার মনের জ্বলন্ত আকাঙ্ক্ষা থেকে, কাজেই আপনাকে অবশ্যই উচ্চাকাঙ্ক্ষা পোষণ করে সে অনুসারে কাজ করতে হবে। তবেই আপনি
সফল ।
মানুষের মৃত্যু আছে কিন্তু শক্তির মৃত্যু নেই। আমরা জেনেছি মহা বীর সোহরাব ও রুস্তমের কাহিনী। দু’জনই দিগ্বিজয়ী মহান বীর। সম্পর্ক পিতা- পুত্রের। পিতার সঙ্গে পুত্রের কোন পূর্ব পরিচয় ছিল না। কিন্তু পিতার মত পুত্রও ছিল অসীম শক্তিশালী মহা বীর, তাই শত্রু পক্ষের ষড়যন্ত্রে যুদ্ধ ক্ষেত্রে পিতার সাথে পুত্রের যুদ্ধ বেঁধে যায়।
বৃদ্ধ পিতাকে চিনতে পারেনি পুত্র। এবং পিতাও পুত্রকে চিনতে পারেনি। শেষে যখন পিতার তরবারির নিচে পুত্রের দেহ পতিত হয়। এক সময় পুত্র সোহরাবের প্রাণ যায় যায় তখন তার মুখ থেকে উচ্চারিত হয়েছিল, ‘আমার পিতা রুস্তম যদি জানতে পারে, তাহলে তোমার মৃত্যু অনিবার্য। এ কথা শুনে পিতার চেতনা ফিরে এল শুধু রুস্তমের পুত্রই তার মোকাবেলা করতে পারে অন্য কেউ তার তরবারির সামনে আসার যোগ্য নয় বা এমন বীর আর নেই। এক সময় সে পুত্রকে চিনতে পারে এবং বুকে জড়িয়ে ধরে ততক্ষণে পুত্ৰ মৃত্যু কোলে নিমজ্জিত
উপসংহার:
এখান থেকে আমরা যা শিখতে পাই তা হল। নও জোয়ানের শক্তির সামনে বৃদ্ধ পিতার শক্তি এতটুকুও কম ছিল না। সুতরাং আমরা অনায়াসেই বুঝতে পারি যে মানুষের মৃত্যু আছে কিন্তু শক্তির মৃত্যু নেই। তাই আপনার মেধাশক্তি, স্মরণ শক্তি, চিন্তা শান্তি, অনুভব শক্তি সকল শক্তিকেই এক যোগে কাজে লাগাতে পারলেই আপনি সফল।