জুমার ফজিলত ও গুরুত্ব

জুমার ফজিলত ফটো

 

জুমার ফজিলত ও গুরুত্ব

أعوذ بالله من الشيطان الرجيم . بسم اللہ الرّحمٰن الرّحیم  – یٰاَ یُّھَا الَّذِینَ اٰمنُوْا اِذَا نُوْدِیَ لِلصَّلٰوۃِ مِنْ یَّوْمِ الْجُمْعَۃِ فَاسْعَوْا اِلٰی ذِکْرِ اللہِ وَذَرُوا الَبَیْعِ ذٰلِکُمْ خَیْرُ لَّکُمْ اِنْ کُنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ – سورۃ الجمعۃ -9 

 

মুহতারাম হাযিরীন!  আজকে আমাদের আলােচ্য বিষয় হলাে–জুমুআর নামায ও তার ফযীলত। জুমুআ শব্দটি আরবি। এর অর্থ সমাবেশ, ইয়াওমুল জুমুআ এর অর্থ, সমাবেশের
দিন।

জুমুআর দিনের নামকরণ:

শুক্রবার দিনের নাম কেনজুমুআ রাখা হলাে এ সম্বন্ধে বিভিন্ন মতামত রয়েছে। কারও মতে এ দিনে আদম আ.-কে তৈরির কাদামাটি জমা করা হয়েছিল, এ কারণে এ দিনের নাম জুমুআ রাখা হয়েছে। কারও মতে আদম ও হাওয়া আ.-কে সৃষ্টির পর এ দিনেই তাদের মধ্যে প্রথম মিলন হয়েছিল তাই এ দিনের নাম রাখা হয়েছেজুমুআ। কারও মতে আদম ও হাওয়া আ. বেহেশত থেকে নিক্ষিপ্ত হওয়ার দীর্ঘকাল পর এ দিনে তাদের মধ্যে পুনরায় সাক্ষাৎ হয়েছিল বিধায় এ দিনের নাম জুমুআ রাখা হয়েছে। কারও মতে এদিনেই কিয়ামত কায়েম হবে এবং হাশরের ময়দানে সমস্ত মানুষের জমায়েত হবে এজন্যই এ দিনের নাম জুমুআ রাখা হয়েছে। প্রতি সপ্তাহে এ দিনটিকে আল্লাহ তাআলা মানব জাতির সমাবেশের দিন হিসেবে নির্ধারণ করেছিলেন। কিন্তু পূর্ববর্তী উম্মতেরা তা পালন করতে ব্যর্থ হয়। ইহুদীরা ইয়াওমুসসাবত তথা শনিবারকে নিজেদের সমাবেশের দিন, খ্রিস্টানরা তাদের সমাবেশের দিন হিসেবে নির্ধারণ করেছেন ইয়াওমুল আহাদ তথা রবিবারকে। আর আল্লাহ তাআলা এই উম্মত মুহাম্মদি কে তাওফীক দিয়েছেন যে, তারা জুমুআর দিন অর্থাৎ, শুক্রবারকে তারা সমাবেশ ও একত্রিত হওয়ার দিন বলে গ্রহণ করেছে।

সপ্তাহের শ্রেষ্ঠ দিন।

জুমুআর দিন সপ্তাহের শ্রেষ্ঠ দিন। আর কোন দিন, কোন রাত, কোন মাস, কোন জায়গা, কোন ব্যক্তি, কোন বস্তুকে শ্রেষ্ঠত্ব দেয়া, মর্যাদা দান করা আল্লাহ তাআলার মর্জি, ও ইচ্ছাধীন বিষয়। তিনি সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা। তিনি শ্রেষ্ঠত্ব, বড়ত্ব ও মর্যাদা দানকারী।
ইরশাদ হচ্ছে:
وَرَبُّکَ یَخْلُقُ مَا یَشَاءُ وَیَخْتَارُ

আপনার পালনকর্তা যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন এবং তিনি মনােনীত করেন।” (সূরা কাসাস: ৬৮)।

তাঁর এ শেষ্ঠত্ব দান ও মর্যাদানের ব্যাপারে কারও দ্বিমত পােষণ করার অধিকার নেই।যেমনিভাবে তিনি সমস্ত ফেরেশতাদের মাঝে হযরত জিবরাঈল আ.-কে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। সমস্ত নবীদের মধ্যে মুহাম্মাদ সা.-কে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। সমস্ত মাসের মধ্যে রমাযান মাসকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। সমস্ত রাতের মধ্যে লাইলাতুল কদরকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। ঠিক তেমনিভাবে সমস্ত দিনের মধ্যে জুমুআর দিনকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। এ শ্রেষ্ঠ দিনেই আল্লাহ তাআলা তার শ্রেষ্ঠ মাখলুক মানব জাতির আদি পিতা হযরত আদম আ.-কে সৃষ্টি করেছেন। এ দিনে জান্নাতে দাখিল করেছেন। আর এ দিনেই তাঁকে জান্নাত থেকে পৃথিবীতে নামিয়ে দিয়েছেন। আর এ দিনে কিয়ামত কায়েম হবে।

জুমুআর দিনে দুআ কবুলের সময়:

জুমুআর দিনে এমন একটা মুহূর্ত আছে, যে মুহূর্তে বান্দা আল্লাহ তাআলার কাছে যে দুআ করলে আল্লাহ ত ‘আলা তা কবুল করেন। এটা একমাত্র জুমুআর দিনেরই এক অনন্য বৈশিষ্ট্য। তবে সে মুহূর্তটাকে আল্লাহ তাআলা বিশেষ হিকমাতে গােপন রেখেছেন, যেমন গােপন রেখেছেন লাইলাতুল কদরের নির্দিষ্ট রাতকে। তবে লাইলাতুল কদর গােপন থাকার পরও যেমনিভাবে এর প্রতি যথেষ্ট ইশারা-ইঙ্গিত রয়েছে, তেমনি জুমুআর দিনের ঐ বিশেষ মুহূর্তকে লাভ করার জন্যে ও উলামায়ে কেরাম বিভিন্ন সম্ভাব্য সময়ের কথা উল্লেখ করেছেন।

 

হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী রহ. হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগায় দুটি সময়কে বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন।

১. ইমাম খুতবা দেয়ার জন্যে যখন মিম্বারে ওঠেন তখন থেকে জুমুআর নামায শেষ হওয়া পর্যন্ত সময়।

২. জুমুআর দিন আসর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়।এই সময় দুটি বিশেষভাবে আল্লাহ তাআলার রহমত বান্দার দিকে রুজু হওয়ার সময়। এই দুটির যে কোন একটি সময়ের মাঝে সে মুহূর্ত আছে, যাতে বান্দা নাফারমানির দুআ ছাড়া যে কোন জায়েয দুআ করলে আল্লাহ তাআলা তা কবুল করার ওয়াদা করেছেন।

ইসলামের ইতিহাসে প্রথম জুমুআ ও জামে মসজিদ

জুমুআর দিনে আল্লাহ তাআলার নিকট সবচেয়ে পছন্দনীয় আমল হলাে জুমুআর নামায। রাসূল কারীম সা. হিজরত করে মদীনায় যাওয়ার পথে কুবায় চৌদ্দদিন অবস্থান করেন। তিনি এখানে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন যার নাম মসজিদে কুবা। এ মসজিদের বৈশিষ্ট্য হলাে কেউ যদি ঘর থেকে ওযু করে মসজিদে কুবায় গিয়ে দুরাকাত নামায আদায় করে তা হলে সে একটাউমরাহ হজ্জ্বের” সওয়াব লাভ করবে। এখান থেকে যখন তিনি মদীনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন, তখন আধা কিলােমিটার উত্তরে বনু সালেম মহল্লায় পৌঁছলে যােহরের ওয়াক্ত হয়, তখন তিনি সেখানে জুমুআর নামায আদায় করেন। পরবর্তীতে সেখানে একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয় এবং তার নাম রাখা হয়মসজিদুল জুমুআ । ইসলামের ইতিহাসে এটিই প্রথম জুমুআ। এতে তিনি এক নাতিদীর্ঘ খুৎবা দেন। এটা ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে এক নযীরবিহীন স্মরণীয় খুৎবা। মক্কার কাফের-মুশরিকদের সীমাহীন নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে মাতৃভূমি ত্যাগ করে মদীনায় এসে সর্বপ্রথম তিনি যে খুৎবা দিলেন, এর কোথাও মক্কাবাসীর বিরুদ্ধে কোন অভিযােগ তিনি করেন নি। তাদের কোন কুৎসা রটনা করেন নি এবং এতে কোন প্রতিশােধ স্পৃহাও তার ছিল না। যা ছিল তা হলাে, আল্লাহ তাআলার প্রশংসা, রিসালতের দাওয়াত, তাকওয়া ও আখিরাতের প্রস্তুতির কথা । সুবহানাল্লাহ! কী সবর, কী ধৈর্য্য, কী সহিষ্ণুতা, কী উদারতা! যারা দীর্ঘ তেরটি বছর পর্যন্ত একটা মুহূর্তও শান্তিতে কাটাতে দেয়নি, তাদের বিরুদ্ধে একটি শব্দ ও তিনি উচ্চারণ করলেন না। তাই তাে আল্লাহ তাআলা ঘােষণা করেছেন:

وَاِنَّكَ لَعَلٰى خُلُقٍ عَظِیْمٍ –

 

 “নিশ্চয় আপনি সুমহান চরিত্র মাধুরীর অধিকারী।” (সূরা ক্বলাম ৪)।

এটাই ছিল ইসলামের ইতিহাসে সর্বপ্রথম জুমুআ ও সর্বপ্রথম জুমুআর খুৎবা। অবশ্য মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাকে সহীহ সনদে আল্লামা ইবনে সীরীন থেকে বর্ণিত আছে যে, দ্বিতীয় বাইয়াতে আকাবার পর যখন মদীনায় ইসলাম ছড়িয়ে পড়লাে, তখন রাসূলুল্লাহ সাঃ মদীনায় আগমনের পূর্বে একবার আনছারগণ একত্রিত হয়ে পরামর্শ করলাে যে, ইয়াহুদীরা সপ্তাহে একদিন সমাবেত হয়ে একত্রে ইবাদত-বন্দেগী করে। খ্রিস্টানরাও সপ্তাহে এক দিনকে তাদের বিশেষ ইবাদতের ও সমাবেশের দিন নির্ধারণ করেছে। আমাদেরও উচিৎ আমরা সপ্তাহে একদিন সমাবেত হয়ে আল্লাহর যিকির, তার হামদ, তাঁর নিয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবাে ও নামায আদায় করবাে। সবাই এতে একমত হলাে এবং দিন নির্ধারণ হলােইয়াওমুল আরবাআঅর্থাৎ, জুমুআর দিন। এরপর আনছারগণ মিলে হযরত আসআদ বিন যুরারাহ রাযি.-এর কাছে গেলেন। তিনি জুমুআর দিন সবাইকে নিয়ে একত্রে
জুমু
আর নামায আদায় করলেন।

জুমুআর দিনের ফযীলত

জুমুআর দিন ও জুমুআর নামাযের বহু ফযীলতের কথা হাদীছে বর্ণিত হয়েছে। রাসূল কারীম সা. ইরশাদ করেন:

َمنِ اغْتَسَلَ يَوْمَ الْجُمْعَةِ وَلَيْسَ مِنْ احْسَنِ ثِیَابِهٖ وَمسَّ مِنْ طِيْبٍ إِنْ كَانَ عِنْدَهٗ ثُمَّ اَتَی الْجَمْعَۃَ فَلَمْ یَتَخَطَّ اَعْنَاقَ النَّاسِ ثُمَّ صَلّٰی مَا كَتَبَ اللهُ لَهٗ ثُمَّ اَنْصَتَ إِذَا خَرَجَ إِمَامَهٗ حَتّٰى يَفْرُغَ مِنْ صَلٰوتِهٖ کَانَتْ کَفَّارَۃً لِمَا بَيْنَهَا وَبَيْنَ جُمْعَةِ الَِّتيْ قَبْلَهَا. رقم:۳۶۳) ۵۰/۱ ابوداود، الطهارة الغسل للجمعةِ

যে ব্যক্তি জুমুআর দিন গােসল করবে, সাধ্য মােতাবেক ভাল পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন কাপড় পরিধান করবে, সুগন্ধি থাকলে তা ব্যবহার করবে। এরপর জুমুআর নামাযের জন্য মসজিদে হাজির হয়ে যারা আগে থেকে বসে আছে। তাদের ডিঙিয়ে আগে না গিয়ে বরং যেখানে জায়গা পায় সেখানে গিয়ে আল্লাহ তাআলা যতটুকু তাওফীক দেন সে মােতাবেক সুন্নত ও নফল পড়বে। আর ইমাম যখন খুৎবাহ দেয়ার জন্য বের হবে তখন আদবের সাথে চুপ থেকে ইমামের দিকে মুতাওয়াজ্জিহ হয়ে মনােযােগ সহকারে খুৎবা শুনবে এবং নামায শেষ করবে- তার এ জুমুআর নামায গত জুমুআর নামায পর্যন্ত কৃত সমস্ত গুনাহর জন্যকাফফারা স্বরূপ হবে। অর্থাৎ, পুরাে এক সপ্তাহের গুনাহ আল্লাহ তাআলা মাফ করে দেবেন। এমন সুসংবাদ এমন ফযীলতের কথা শুনেও সপ্তাহে একটা দিন দুরাকাত নামাযের যে গুরুত্বের কথা ছিল আমরা তা দিই না। আমাদের স্বভাব হলাে, দুনিয়ার কোন লাভের কথা, লােভের কথা, প্রাপ্তির কথা শুনলে সে দিকে আমরা হুমড়ি খেয়ে পড়ি। আর আখিরাতে পাওয়ার কথা শুনেও না শুনার ভান করি।

জুমুআর নামাযে আগমনকারীদের স্তরঃ

জুমুআর নামাযে আগমনকারীদের স্তর সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেছেন:

إِذَا كَانَ يَوْمُ الْجُمْعَةِ وَقَفَتِ الْمَلٰئِكَةُ عَلٰى بَابِ الْمَسْجِدِ تَکْتُبُوْنَ الْأَوَّلَ فَالْاَوَّلَ وَمَثَلُ الْمُھَجِّرِ كَمَثَلِ الَّذِيْ يُهْدِيْ بُدْنَۃً ثُمَّ يُهْدِيْ بَقَرَۃً ثُمَّ كَبْشًا ثُمَّ دَجَاجَةً ثُمَّ بَيْضَةً فَإِذَا خَرَجَ الْإِمَامُ طَوَوْا صُحُفَهُمْ وَيَتسْتَمِعُوْنَ الذِّکْرَ۔ البخاری ، الجمعۃ – الاستماع الی الخطبۃ – 1/ 127 – رقم – 929

“যখন জুমু’আর দিন হয় তখন ফেরেশতাগণ মসজিদের দরজায় হাজির হয়ে দাঁড়িয়ে যায়, এবং যারা প্রথমে আসে তাদের নাম ক্রমানুসারে রেজিষ্টারে লিখতে থাকে। সর্বপ্রথম জুমু’আর নামাযের জন্য যে ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করে তার উদাহরণ হলাে ঐ ব্যক্তির ন্যায় যে আল্লাহর রাস্তায় একটি উট কুরবানী করে। দ্বিতীয় পর্যায় যে আগমন করে তার উদাহরণ ঐ ব্যক্তির ন্যায় যে একটা গরু কুরবানী করে। তৃতীয় পর্যায় যে ব্যক্তি আগমন করে তার দৃষ্টান্ত হলাে, আল্লাহর রাস্তায় বকরী কুরবানকারীর ন্যায়। চতুর্থ পর্যায় যে ব্যক্তি আগমন করে তার উদাহরণ হলাে মুরগী সদকাকারীর ন্যায়। আর এর পর যে আসে তার উদাহরণ হলাে আল্লাহর রাস্তায় ডিম সদকাকারীর ন্যায়। এরপর যখন ইমাম খুত্ব দেয়ার জন্য বের হয় তখন ফেরেশতাগণ তাদের রেজিষ্টার বন্ধ করে খুৎবা শুনতে মশগুল হয়ে যায়।” এ হাদীছে জুমু’আর দিন যারা মসজিদে নামায পড়তে আসে তাদের স্তর বর্ণনা করা হয়েছে। আগে আসলে কী লাভ, কী ফায়দা তা বর্ণনা করা হয়েছে। অথচ আমরা দুনিয়াদার মানুষ পরকালীন লাভের কথা শুনেও শুনি না। আর সেটা জানিও না। কারণ আমরা নগদে বিশ্বাসী। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযি. বলেন “সাধারণ মানুষের মধ্যে ইহকালকে পরকালের উপর প্রাধান্য দেওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। এর কারণ এই যে, ইহকালের নি’আমত ও সুখ স্বাচ্ছন্দ উপস্থিত এবং পরকালের নি’আমত ও সুখ স্বাচ্ছন্দ দৃষ্টি থেকে কাফেলা এসেছে এবং ঐ কাফেলায় ওয়ায়েস করনী আছে। সংবাদ পেয়ে হযরত উমর রাযি. খুব খুশি হলেন, গিয়ে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন, তার নাম জিজ্ঞেস করলেন এবং নবী করীম সা. তার যে নিদর্শন বলে ছিলেন, তাও লক্ষ্য করলেন। এরপর বললেন, আপনি আমার জন্য একটু দুআ করুন। হযরত ওয়ায়েস করনী বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন। বললেন, আপনি খলীফাতুল মুসলিমীন! রাসূলে কারীম সা.-এর জলীলুল কদর সাহাবী। আমার কাছে দু’আর জন্য আসলেন! হযরত উমর রাযি. বললেন, রাসূলে কারীম সা. আমাকে ওসিয়্যাত করে গেছেন আপনাকে দিয়ে দু’আ করানাের জন্য। এ কথা শুনে ওয়ায়েস করনীর দুচোখ বেয়ে ঝর ঝর করে অশ্রু গড়িয়ে পড়লাে। তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ সা. আমার ব্যাপারে এমন কথা বলেছেন! ওয়ায়েস করনী এই বিশেষ মর্যাদা তাঁর মায়ের খিদমাত ও তাঁর দুআর বদৌলতেই লাভ করেছিলেন। সাহাবী না হয়েও রাসূলুল্লাহ সা. সাহাবীদেরকে তার কাছে দু’আর জন্য পাঠিয়ে দিলেন।

মায়ের বদ-দু

মায়ের দুআ যেমন লাগে তেমনি মা যদি বদ-দুআ করেন তা হলে তাও সাথে সাথে লেগে যায়। ইমাম বুখারী রহ. তার লিখিতআল আদাবুল মুফরাদনামক গ্রন্থে হযরত আবু হুরায়রা রাযি. থেকে এক দীর্ঘ হাদীছ বর্ণনা করেছেন। হযরত আবু হুরায়রা রাযি. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সা.-কে বলতে শুনেছি, ঈসা ইবনে মারয়াম আ. এবং জুরায়েজ ওয়ালা ছাড়া আর কোন মানব সন্তানই ভূমিষ্ঠ হওয়া মাত্র মাতৃকোলে কথা বলেনি। তখন তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলাে, ইয়া রাসূলাল্লাহ! জুরায়জ ওয়ালা আবার কে? ফরমালেন, জুরায়জ ছিলেন একজন আশ্রমবাসী সংসারত্যাগী দরবেশ। তার আশ্রমের পাশেই এক রাখাল বাস করতাে। গ্রামবাসিনী এক মহিলা সে রাখালের কাছে আসা-যাওয়া করতাে।

জুরায়েজের ঘটনা:

একবার জুরায়েজের মাতা তার দ্বারপ্রান্তে এসেজুরায়জ, জুরায়েজ, বলে ডাকতে লাগলেন। তিনি তখন তপস্যারত, কঠোর সাধনায় লিপ্ত ছিলেন। একদিকে মায়ের ডাক অপর দিকে তপস্যা কোনটাকে প্রাধান্য দিবেন! চিন্তাভাবনা করে তিনি তপস্যাকে প্রাধান্য দিলেন। মা পরপর তিনবার তার দুয়ারে হাঁক দিয়েও যখন কোন জবাব পেলেন না, তখন মা তাকে অভিশাপ দিলেন, “পতিতা নারীদের মুখ না দেখিয়ে যেন আল্লাহ তাআলা তাের মৃত্যু না ঘটান।এ কথা বলে তার মাতা চলে গেলেন। ঘটনাক্রমে সদ্যভূমিষ্ঠ এক শিশু সন্তানসহ এক মহিলাকে রাজদরবারে হাজির করা হলাে। রাজা জিজ্ঞেস করলেন, কার ঔরসে এ শিশুর জন্ম? সে মহিলা বললাে, জুরায়জের ঔরসে। রাজা আবার জিজ্ঞেস করলেন, আশ্রমবাসী জুরায়জ? মহিলা বললাে, জ্বী হ্যা। রাজা তখন তার লােকজনকে নির্দেশ দিলেন আশ্রমটিকে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দাও এবং ভণ্ড দরবেশকে আমার দরবারে হাজির কর। লােকজন কুঠার আঘাতে সাধুর আশ্রম ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়ে সাধুর হস্ত দ্বয় ঘাড়ের সঙ্গে রশি দিয়ে বেধে রাজদরবারে হাজির করলাে। যাওয়ার পথে কয়েকজন পতিতা নারী তার সামনে পড়লাে।
সাধু পতিতা নারীদের দেখে মৃদু হাসলেন।
| রাজদরবারে হাজির করার পর রাজা এক মহিলার দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, সাধু প্রবর! সে কী বলে জানেন? সাধু বললেন, কী বলে? রাজা বললেন, সে বলে ঐ শিশুটি আপনার ঔরসজাত। সাধু তখন পতিতাকে লক্ষ্য করে বললেন, সত্যি সত্যি কি তুমি এ কথা বলাে? সে বললাে, হ্যাঁ। সাধু বললেন, কোথায় সে সন্তান? লােকেরা বললাে, ঐ যে তার মায়ের কোলে। সাধু তখন তার সম্মুখে গেলেন এবং শিশুটিকে লক্ষ্য করে বললেন, কি হে, তােমার পিতা কে? তৎক্ষণাৎ শিশুটি বলে উঠলাে, আমার পিতা গরুর রাখাল।
এবার লজ্জিত অনুতপ্ত রাজা বললেন, সাধু প্রবর! আমরা কি স্বর্ণ দ্বারা আপানার আশ্রম গড়ে দেবাে? না রুপা দ্বারা গড়ে দেবাে? সাধু বললেন, পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে দিন। তখন রাজা জিজ্ঞেস করলেন, তবে আপনার মৃদু হাসির হেতু কী? সাধু বললেন, মৃদু হাসির পেছনে একটি ব্যাপার আছে যা আমি জানি, তা হলাে আমার মায়ের অভিশাপই আমাকে স্পর্শ করেছে। অতঃপর সকল ঘটনা তাদেরকে খুলে বললেন।৩৮ উক্ত হাদীছ থেকে দুটি বিষয় স্পষ্টভাবে বুঝা গেল।

১. মা যদি কোন কারণে মনােক্ষুন্ন হয়ে বদ-দুআ করেন সন্তান সে দোষে দোষী না হলে ও তাকে ক্ষণিকের জন্য হলেও বিপদে পড়তে হয়, ব্রিতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন
হতে হয়।

২. ক্ষেত্রবিশেষে পিতা-মাতার ডাকে সাড়া দেয়া আল্লাহর ইবাদতের চেয়েও অগ্রগণ্য। কেননা, ইবাদতের সময় যদি একটু-আধটু দেরী হয়ে যায়, তবে তা পরেও সেরে নেয়া যায়, কিন্তু বৃদ্ধ পিতা-মাতা যদি ডেকে সাড়া না পান এবং এতে তাদের মনে ব্যাথা লাগে, তবে তা সন্তানের জন্য একটি অপূরণীয় ক্ষতির কারণ হয়। তাই নামাযে থাকা অবস্থায়ও যদি পিতা-মাতা ডাকেন, তবে নামায ছেড়ে আগে তাদের কথা শুনতে হবে । তাই ক্ষেত্র বিশেষে আল্লাহ তাআলা নিজের ইবাদতের চেয়েও পিতা-মাতার | ‘হকের গুরুত্ব বেশি দিয়েছেন। পিতা-মাতা সন্তানের জন্য একটা অনায়াস লব্ধ সম্পদ। দুনিয়ায় নেকী-সওয়াব, অর্জন করার সবচেয়ে সহজ মাধ্যম হলাে পিতামাতা। বায়হাকী শরীফে হযরত ইবনে আব্বাস রাযি. থেকে একটি হাদীছ বর্ণিত রয়েছে। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেন, যে সেবাযত্নকারী পুত্র পিতা-মাতার দিকে দয়া ও ভালােবাসাসহকারে দৃষ্টিপাত করে, তার প্রত্যেক দৃষ্টির বিনিময়ে সে
একটি মকবুল হজের সওয়াব লাভ করে। লােকেরা আরজ করলাে
, সে যদি দিনে একশবার এভাবে দৃষ্টিপাত করে? তিনি বললেন, হ্যা, একশবার দৃষ্টিপাত করলেও প্রত্যেক দৃষ্টির বিনিময়ে এই সওয়াব পেতে থাকবে।
মােটকথা, বহু আয়াত ও হাদীছে পিতা-মাতার সহিত সদ্ব্যবহারের জোর তাগিদ দেয়া হয়েছে। কোথাও বলা হয়েছে আল্লাহর সন্তুষ্টি পিতার সন্তুষ্টির মধ্যে এবং আল্লাহর অসন্তুষ্টি পিতার অসন্তুষ্টির মধ্যে নিহিত রয়েছে। আবার কোথাও বলা হয়েছে, মায়ের পায়ের নীচে সন্তানের বেহেশত। তাই আমরা যদি দুনিয়ায় কামিয়াবী ও আখিরাতে মুক্তি চাই, তা হলে অবশ্যই পিতা-মাতার অধিকার সম্পর্কে আমাদেরকে আরও সতর্ক হতে হবে। তাদের প্রতি আমাদের কর্তব্যকে যথাযথভাবে পালন করতে হবে। আর যাদের পিতামাতা দুনিয়া থেকে চলে গেছেন তাদের কর্তব্য হলাে, মৃত পিতা-মাতার জন্য দুআ ও ইস্তিগফার করতে হবে। দান-সাদকার মাধ্যমে ইসালে সওয়াব করতে হবে, এবং পিতা-মাতার আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের সাথে সদ্ব্যবহার করতে হবে। যারা এরূপ করবে আল্লাহ তাআলা তাদেরকেও পিতা-মাতার বাধ্যগত সন্তানদের অন্তর্ভুক্ত করবেন। সবশেষে মহান আল্লাহর দরবারে এ দুআ করছি, তিনি যেন আমাদেরকে পিতা-মাতার খিদমাতের মাধ্যমে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের তাওফীক্ব দেন। আমীন!

Thank you for reading the post.

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top