হিজরী সন এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য

হিজরী সনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

 

হিজরী সন এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য:

أَعُوذُ بِاللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّحِيْمِ. بِسْمِ اللهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ إِنَّ عِدَّةَ الشُّهُورِ عِنْدَ اللهِ اثْنَا عَشَرَ شَهْرًا فِي كِتَبِ اللهِ يَوْمَ خَلَقَ السَّمَوتِ وَالْأَرْضَ مِنْهَا اَرْبَعَةٌ حُرُمٌ ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ فَلَا تَظْلِمُوا فِيهِنَّ أَنْفُسَكُمْ وَقَاتِلُوا الْمُشْرِكِينَ كَافَةً كَمَا يُقَاتِلُونَكُمْ كَافَةً وَاعْلَمُوا أَنَّ اللهَ مَعَ الْمُتَّقِينَ (سورة التوبة: ٣٦) قال رسول الله صلى الله عليه وسلم أَفْضَلُ الصِّيَامِ بَعْدَ رَمَضَانَ شَهُرُ اللهِ الْمُحَرَّمَ (رواه مسلم فضل صوم المحرم ٣٦٨/١ رقم: ١١٦٣)
মুতারাম হাযিরীন!
হিজরী সনের প্রথম মাস মুহাররম। মুহাররম শব্দের অর্থ নিষিদ্ধ, সম্মানিত, মর্যাদাসম্পন্ন। হিজরী সনের প্রথম মাস হিসেবে মুহাররমের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনেক বেশি। রাসূলুল্লাহ সা.-এর মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করে চলে যাওয়ার তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখার নিমিত্তেই পরবর্তীতে হিজরী সনের প্রবর্তন করা হয়। রাসূলুল্লাহ সা.-এর মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত ইসলামের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা। মক্কার কাফের মুশরিক ও পৌত্তলিকদের সীমাহীন নির্যাতন ও নিপীড়নে অতিষ্ঠ হয়ে তিনি আল্লাহ’র নির্দেশে মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করেন। তাই হিজরত ইসলামের ইতিহাস ও মহানবী সা.-এর জীবন ধারার গতি পালটে দেয় ।

হিজরতের বরকত

হিজরতের ফলে মক্কায় উপেক্ষিত ইসলাম মদীনায় একটি বিজয়ী ও গ্রহণযোগ্য আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। রাসূলুল্লাহ সা. যিনি মক্কায় একজন ধর্মপ্রচারক হিসেবেই ছিলেন পরিচিত। মদীনায় এসেই তিনি একজন শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রনায়ক, সুদক্ষ সেনাপতি আদর্শ সমাজ-সংস্কারক হিসেবে আবির্ভূত হন । যে মুসলমানগণ মক্কায় ছিলেন নির্যাতিত, নিগৃহিত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, মদীনায় এসে তাঁরাই মর্যাদা সম্পন্ন ও সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। সর্বোপরি ইসলাম একটি সার্বজনীন ও আন্তর্জাতিক জীবনাদর্শ হিসেবে ব্যাপক প্রচারের সুযোগ লাভ করে। তাই হিজরত ইসলামের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা । হিজরী নববর্ষ আমাদেরকে সে কথাই স্মরণ করিয়ে দেয় ।
চান্দ্র মাসের হিসেব রাখা ফারযে কিফায়া
মুহাররম থেকে হিজরী নববর্ষ শুরু হয় আর যিলহজ্ব মাসে শেষ হয়। হিজরী সন গণনা করা হয় চান্দ্র মাসের হিসেব অনুযায়ী। এর সাথে আমাদের ধর্মীয় অনেক বিষয় জড়িত। অনেক আমল শুদ্ধ হওয়া না হওয়া এর সঙ্গে সম্পৃক্ত। যেমন: রোযা, হজ, যাকাত, ঈদ, কুরবানী ইত্যাদি। এ কারণে চান্দ্র মাসের হিসেব রাখা মুসলমানদের জন্য ফারযে কিফায়া ঘোষণা করা হয়েছে। অর্থাৎ, এটা এমন একটা আমল যার সাথে সমস্ত মুসলমান জড়িত, মুসলমানের আমল জড়িত। মুসলমানদের একটি দল যদি এর হিসেব রাখে, তা হলে সবার পক্ষ থেকে ফারযের জিম্মাদারী আদায় হয়ে যাবে। আর যদি কেউ হিসেব না রাখে, তা হলে সকলে ফরয পরিত্যাগ করায় গুনাহগার হবে। যেমন জানাযার নামায ফারযে কিফায়া। কিছু সংখ্যক লোক যদি তা আদায় করে, তা হলে সবার পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যাবে। কেউ আদায় না করলে সকলে গুনাহগার হবে। আমাদের দেশে এ কাজটি সরকারীভাবে ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটির মাধ্যমে হয়ে থাকে। যদি এ ব্যবস্থা না থাকতো, তা হলে প্রতি মাসেই আমাদের এ কাজ করতে হতো। অন্যথায়, আমরা কোন ইবাদত ঠিকমত করতে পারতাম না ৷
চাঁদের হিসাব এত জরুরী যে, যদি একদিন কমবেশি হয়ে যায়, তা হলে অনেক অসুবিধা আর ক্ষতির সম্মুখীন হবো আমরা। যেমন ধরুন, শাবান মাস ২৯শে ছিল, কিন্তু আমরা যদি ৩০শে ধরে নেই, তা হলে মাহে রমাযানের একটা অতি মূল্যবান দিন আমাদের হাতছাড়া হেয়ে গেল । আর ইচ্ছাপূর্বক একটা রোযা নষ্ট করে কেউ যদি সারা বছরও রোযা রাখে, তা হলেও ঐ একদিনের রমাযানের ফযীলত লাভ করতে পারবে না। ঠিক তেমনিভাবে ইয়াওমে আরাফা বা যিলহজ মাসের নবম তারিখ, যদি কেউ আট তারিখে উকূফে আরাফা করে, তা হলে তার হজ হবে না। ১০ই যিলহজ কুরবানী যদি ৯ই যিলহজ করে তা হলে কুরবানী রমাযান মাসের একদিন বাকি থাকতে যদি ঈদের নামায পড়ে তা হলে ঈদও হবে না।
এভাবে অনেক ইবাদতেই আমাদের বিঘ্নতা ঘটবে যদি আমরা , চান্দ্র মাসের হিসেব না রাখি। তাই শরীয়ত চান্দ্র মাসের হিসেব রাখাকে ফারযে কিফায়া হিসেবে ঘোষণা করেছে। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমরা মুসলমান, আমাদের মাঝে অনেক জ্ঞানী-গুণীজনরাও আরবি বর্ষ, নববর্ষ সম্পর্কে কোন খবরই রাখেন না। পক্ষান্তরে জ্ঞানী-গুণী, শিক্ষিত-অশিক্ষিত সমাজের প্রায় সর্বস্তরের মানুষই ইংরেজী নব-বর্ষকে বরণ করে নেয়ার জন্য থার্টিফাস্ট নাইটের অপেক্ষায় রাত জেগে বসে থাকে। আর এ নববর্ষ উদযাপনে আমোদ-প্রমোদের মাঝে কত যে অঘটন ঘটে তার কোন ঠিক-ঠিকানা নেই ।
ঠিক তেমনিভাবে বাংলা নববর্ষ পহেলা বৈশাখ ভোর বেলায় রমনা পার্কে গিয়ে এক সানকি পান্তাভাত আর এক টুকরো ইলিশ ভাজা খেতে পারলে আমরা যে কোন স্বর্গে চলে যাই, তাও আমরা জানি না। অথচ এ সবের সঙ্গে না আছে ইসলামের কোন সম্পর্ক, না আছে আমাদের ঈমান-আমালের কোন সম্পর্ক, না আছে ইহকালীন কোন কল্যাণ, না আছে পরকালীন মুক্তির কোন ব্যবস্থা। বিজাতীয় সভ্যতা সংস্কৃতির সয়লাবে আমরা ভেসে যাচ্ছি দীন-ধর্ম থেকে অনেক দূরে। বহু দূরে… । অথচ আমাদের উচিত এসব থেকে দূরে থাকা । কবি সুন্দর বলেছেন:
قوت نیکی نداری بد مکن – بر وجود خو د ستم بے حد مکن
“ভালকাজ করতে না পারলেও মন্দকাজ করো না এবং মন্দকাজ করে নিজের উপর সিমাহীন জুলুম করো না।”

মুহাররমের তাৎপর্য

,
যাই হোক, আমি মুহাররম মাস সম্পর্কে বলছিলাম। মুহাররম হিজরী সনের প্রথম মাস। মুহাররম শব্দের দু’টি অর্থ,
১. নিষিদ্ধ, অর্থাৎ, মহানবী সা.-এর পূর্বের যুগ থেকেই মুহাররম সহ চারটি মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহ, হানা-হানি, কাটা-কাটি বিশেষভাবে নিষিদ্ধ ছিল এবং ইসলাম ধর্মেও প্রাথমিকভাবে সে নিষেধাজ্ঞা বহাল ছিল। কিন্তু কাফেরদের পক্ষ থেকে এর অবমাননা ও বাড়াবাড়ির কারণে পরবর্তীতে ইসলামেও এ নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়েছে। এখন যে কোন সময়েই কাফেররা মুসলমানদের উপর হামলা করলে মুসলমানগণ নিষিদ্ধ মাসের অপেক্ষায় বসে না থেকে এর সমুচিত জবাব দেবে। এ চারটি মাস হচ্ছে, যিলক্বদ, যিলহজ, মুহাররম ও রজব। এ হলো মুহাররমের অর্থ নিষিদ্ধ হওয়ার তাৎপর্য।
২. মুহাররম অর্থ সম্মানিত। এটা এখনও বহাল আছে। এ সম্মানের কথা কুরআনে কারীমে আল্লাহ তাআলা এভাবে ঘোষণা করেছেন। ইরশাদ হচ্ছে:
اِنَّ عِدَّةَ الشُّهُورِ عِنْدَ اللهِ اثْنَا عَشَرَ شَهْرًا فِي كِتَبِ اللَّهِ يَوْمَ خَلَقَ السَّمَوتِ وَ الْأَرْضَ مِنْهَا أَرْبَعَةٌ حُرُمٌ ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ فَلَا تَظْلِمُوا فِيهِنَّ أَنْفُسَكُمْ وَ قَاتِلُوا الْمُشْرِكِيْنَ كَأَفَةً كَمَا يُقَاتِلُونَكُمْ كَافَّةً وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ مَعَ الْمُتَّقِينَ
“নিশ্চয় আল্লাহ’র বিধান ও গণনার মাস বারটি, আসমানসমূহ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকে। তন্মধ্যে চারটি সম্মানিত। এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। সুতরাং এর মধ্যে তোমরা নিজেদের প্রতি অত্যাচার করো না। আর মুশরিকদের সঙ্গে তোমরা যুদ্ধ কর সমবেতভাবে, যেমন তারাও তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে যাচ্ছে সমবেতভাবে। আর মনে রেখো, আল্লাহ মুত্তাক্বীদের সাথে রয়েছেন।” (সূরা তাওবা: ৩৬)
আল্লাহ’র কাছে মাসের সংখ্যা বারটি। এতে কম বেশি করার ক্ষমতা কারও নেই। এটা রোযে আযল অর্থাৎ, সৃষ্টির প্রথম দিন থেকেই লাওহে মাহফূযে লিখিত রয়েছে এবং এই বারমাসের মধ্যে চারটি মাস বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ একথাও লিখিত আছে । সুতরাং আল্লাহ তাআলা বলেন:
فَلَا تَظْلِمُوا فِيهِنَّ أَنْفُسِكُمْ
“এ মাসগুলোতে নিজেদের উপর জুলুম করো না।” অর্থাৎ, এ পবিত্র মাসগুলোর যথাযথ আদব রক্ষা না করে এবং ইবাদত-বন্দেগীতে অলস থেকে নিজেদের ক্ষতি করো না ৷
ইমাম জাস্সাস রহ. “আহকামুল কুরআন” গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, কুরআনের এ বাক্য “  ” দ্বারা ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, এ মাসগুলোর এমন বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যার ফলে এতে ইবাদত করা হলে বাকি মাসগুলোতেও ইবাদতের তাওফীক্ব ও সাহস লাভ করা যায়। অনুরূপভাবে কেউ এ মাসগুলোতে পাপাচার থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারলে বছরের বাকি মাসগুলোতেও পাপাচার থেকে দূরে থাকা সহজ হয়।”

এ যাবত আলোচনা থেকে আমরা কয়েকটি বিষয় জানতে পারলাম:

১. মুহাররম হিজরী সনের প্রথম মাস। মুহাররমের এক তারিখ আরবি নববর্ষের ১ম দিন ।
২. চান্দ্র মাসের হিসেব রাখা সকল উম্মতের উপর ফারযে কিফায়া ।
৩. মুহাররম মাসে বেশি বেশি ইবাদত করতে হবে, তা হলে অন্য মাসেও ইবাদতের তাওফীক্ব লাভ হবে ।

মুহাররমের আমল

এখন কথা হলো, আমরা এ মাসে কোন কোন ইবাদত বেশি বেশি করবো এবং তার পদ্ধতিটা কী? এর সহজ জবাব হচ্ছে, এ মাসে কোন নির্ধারিত ইবাদত নেই এবং এর সুনির্দিষ্ট কোন নিয়মও নেই। তবে কিছু কিছু দু’আ, দুরুদ ও বাংলা ওযীফার বই রাস্তঘাটে ফেরিওয়ালাদের কাছে পাওয়া যায়, যেগুলোর মধ্যে নফল ইবাদতকে অহেতুক নানা রীতি-নিয়মের বেড়াজালে আবদ্ধ করে মানুষকে বিপদে ফেলে দিয়েছে। এসব বইয়ের কোন নির্ভরযোগ্যতা না থাকলেও মহিলাদের কাছে খুব গ্রহণযোগ্য। আর বই একটা ঘরে থাকলে মহিলাদের পাশাপাশি অবসরে পুরুষেরাও পড়ে। এরপর শবে বরাত, শবে কদরে এসে জিজ্ঞেস করে, হুযূর! কদরের নামায কয় রাকাত? বরাতের নামায কয় রাকাত? আচ্ছা, প্রথম তো ফাতেহা পড়লাম, এরপর সূরা ইখলাস কয়বার পড়তে হবে? এমন নানা প্রশ্ন। অথচ নাফলের ক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য বর্ণনা মতে এ ধরনের নিয়ম-নীতির কোন বালাই নেই ।

মুহাররমের এক নম্বর আমল

মুহাররমের এক নম্বর আমল হচ্ছে, পুরো মাসে যে কোন দিন রোযা রাখা, তা হলে অন্য মাসে নফল রোযা রাখলে যে সওয়াব তার চেয়ে বেশি সওয়াব লাভ করা যাবে। যেমন রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেন:
أَفْضَلُ الصِّيَامِ بَعْدَ رَمَضَانَ شَهُرُ اللهِ الْمُحَرَّمَ (مسلم، الصيام فضل صوم المحرم
“রমাযান মাসের রোযার পর সর্বশ্রেষ্ঠ রোযা আল্লাহ’র মাস মুহাররমের রোযা । ”১২২

মুহাররমের দুই নম্বর আমল

মুহাররমের দুই নম্বর আমল হচ্ছে, দশ তারিখ (আশুরার) রোযা রাখা। রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেন:
صِيَامُ يَوْمِ عَاشُورَاءَ اِنّى اَحْتَسِبُ عَلَى اللهِ أنْ يُكَفِّرَ السَّنَةَ الَّتِي قَبْلَهُ وَالسَّنَةَ الَّتِي
بعدة (صحيح مسلم، الصيام استحباب صيام ثلاثة ايام ٣٦٧/١ رقم: ١١٦٢)
“আমি আল্লাহ তাআলার দরবারে আশা রাখি যে, ১০ মুহাররমের রোযা তার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী এক বছরের গুনাহ’র কাফফারা হবে ।
“১২৩

আশুরার রোযা যেভাবে এলো

আশুরার রোযা কোত্থেকে এলো? এ ব্যাপারে হাদীছে আছে যে, রাসূলুল্লাহ সা. যখন হিজরত করে মদীনায় গেলেন, তখন তিনি দেখলেন, মুহাররমের ১০ তারিখ আশুরায় ইয়াহুদীরা রোযা রাখছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কেন এ রোযা রাখছ? উত্তরে তারা বললো, এ দিনে আল্লাহ তাআলা মূসা আ. ও বনী ইসরাঈলের জন্যে সমুদ্রের ভেতর দিয়ে রাস্তা করে দিয়েছিলেন। সে রাস্তায় তারা সাগর পাড়ি দিয়ে তীরে উঠেছিলেন এবং ফিরাউন তার দলবলসহ নিমজ্জিত হয়েছিল। সে জন্য শুকরিয়া সরূপ হযরত মূসা আ. এ দিনে রোযা রেখেছিলেন, তাই আমরা তাঁর অনুসারীরাও রোযা রাখি। তখন রাসূলুল্লাহ সা. বললেন:
نَحْنُ أَحَقُّ بِمُوسَى مِنْكُمْ فَصَامَهُ وَأَمَرَ بِصِيَامِهِ (سنن ابن ماجه، الصيام صيام يوم عاشوراء ص: ١٢٤ رقم: ١٧٣٤)
“আমরা তোমাদের চেয়ে মূসা আ.-এর অনুসরণের অধিক যোগ্য। তাই তিনি রোযা রাখলেন এবং সাহাবীদেরকেও রোযা রাখার নির্দেশ দিলেন ,  তবে সাথে সাথে তিনি এ কথাও বললেন:
صُومُوا عَاشُورَاءَ وَخَالِفُوا فِيْهِ الْيَهُودَ وَ صُومُوا قَبْلَهُ يَوْمًا وَبَعْدَةً يَوْمًا ا (صحیح ابن خزيمة، رقم: ٢٠٩٥)
“আশুরা দিবসে রোযা রাখ এবং এতে ইয়াহুদীদের বিরুদ্ধাচরণ কর । (তারা মাত্র একদিন রোযা রাখে) তোমরা তাদের পূর্বের দিন বা পরের দিন রোযা রাখ ।”
সুতরাং আশুরা তথা মুহাররমের দশ তারিখে রোযা রাখা এবং তার আগে পরে আরও একটি রোযা অর্থাৎ, ৯/১০ বা ১০/১১ তারিখে রোযা রাখা মুস্তাহাব । আর কেউ যদি শুধু দশ তারিখে রোযা রাখে তা হলে রোযা হবে, তবে তা মাকরুহে তানযিহী। এ হলো রোযা রাখার তাৎপর্য ।

মুহাররমের তিন নম্বর আমল

মুহাররমের তিন নম্বর আমল হচ্ছে, দশ তারিখে তথা আশুরার দিন নিজ নিজ পরিবার পরিজনের খাদ্য-খোরাকে স্বাভাবিকের চেয়ে একটু মুক্তহস্ত হওয়া। রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেন:
مَن وَشَعَ عَلَى عِيَالِهِ فِي النَّفَقَةِ يَوْمَ عَاشُورَاءَ وَشَعَ اللهُ عَلَيْهِ سَائِرَ سَنَتِهِ
“যে ব্যক্তি আশুরা দিবসে পরিবার পরিজনের জন্য মুক্তহস্তে ব্যয় করবে, আল্লাহ তাআলা তাকে সারাবছর সচ্ছলতা দান করবেন। | ”
এ হলো মুহাররমের তাৎপর্য, আশুরার করণীয় ও বর্জনীয় বিষয় ।

আশুরা মানে কারবালা নয়

কিন্তু বর্তমান সমাজ আশুরাকে কারবালায় পরিণত করে ফেলেছে। তাই মুহাররম তথা আশুরা এলেই আমাদের বদ্ধমূল ধারণা হয় যে, কারবালার মর্মান্তিক ও হৃদয় বিদারক ঘটনার কারণেই আলামে ইসলামে মুহাররম বা আশুরার এত গুরুত্ব। মূলত এটা ঠিক নয়। কেননা কারবালার ঘটনার বহুকাল পূর্বে পৃথিবীর ইতিহাসে অনেক ঐতিহাসিক ঘটনা এ দিনে ঘটেছে। অনেক জাতির উত্থান- পতন এদিনে হয়েছে। আল্লাহ তাআলা তাঁর বিশেষ বান্দাদের প্রতি এ দিনে রহমত করেছেন। এ কারণেই তো রাসূলুল্লাহ সা. নিজে রোযা রেখেছেন এবং রোযা রাখার নির্দেশও দিয়েছেন। কারবালার সঙ্গে মুহাররম তথা আশুরার কোন সম্পর্ক নেই। কেননা কারবালার ঘটনা সংঘটিত হয়েছে হিজরী ৬১ সনে। রাসূলুল্লাহ সা.-এর ইন্তেকালের প্রায় অর্ধ শতাব্দি পর। আর কোন দিন, কোন সময়, কোন স্থানের মর্যাদাসম্পন্ন হওয়া না হওয়ার সম্পর্ক শরীয়তের আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে। আর রাসূল সা. যখন মুহাররম তথা আশুরার ব্যাপারে এত ফযীলতের কথা বলা সত্বেও একটিবারও কারবালা সম্পর্কে কিছু বলে যাননি, তা হলে বুঝা যায় যে, কারবালার নামে মানুষ যা করছে এটা নিতান্তই মনগড়া। দীন ও ইসলামের সাথে এর নূন্যতম কোন সম্পর্ক নেই ।

জন্মদিবস, মৃত্যুদিবস পালন করা বিদ’আত

কারবালার সাথে আশুরার কোন সম্পর্ক নেই। এর অর্থ এই নয় যে, নবীর দৌহিত্র হযরত হুসাইন রাযি.-এর প্রতি আমাদের অন্তরে কোন দরদ নেই, কোন ভালোবাসা নেই। বরং আমরা বলতে চাই আশুরার নামে শিয়া সম্প্রদায়ের লোকেরা যে শোক মিছিল করছে, মাতম করছে, বিলাপ করছে, তাযিয়া বানিয়ে ঢোল-তবলা পিটিয়ে শোভাযাত্রা সহকারে প্রতিমা বিসর্জনের ন্যায় বিসর্জন দিচ্ছে এ গুলো সম্পূর্ণ বিদ’আত। অনৈসলামিক কার্যকলাপ। এর দ্বারা উদ্দেশ্য মুসলমানদেরকে আশুরার মৌলিক আবেদন থেকে সরিয়ে গুনাহ এবং নাফরমানীতে লিপ্ত করা। অথচ ইসলামে জন্মদিবস-মৃত্যুদিবস ও শোক দিবস বলতে কিছুই নেই এবং এর কোন গুরুত্বও নেই। বরং এগুলোর বাপারে শরী’আতের পক্ষ থেকে ধিক্কার এসেছে। রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেন:
لَيْسَ مِنَّا مَنْ ضَرَبَ الْحُدُودَ وَشَقَّ الْجُيُوبَ وَدَعَا بِدَ عُوا الْجَاهِلِيَّةِ وَدَعَابِدَ
(البخارى، الجنائز ليس منا من ضرب الخدود، ۱۷۲/۱ رقم: ۱۲۹۷)
“যে ব্যক্তি (শোকে-দুঃখে) চেহারায় চপেটাঘাত করে, জামার বুক ফেঁড়ে ফেলে এবং জাহেলী যুগের ন্যায় হায়-হুতাশ করে, সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত
নয় ।”১২৭

শিয়াদের অপসংস্কৃতির আগ্রাসন

শিয়া সম্প্রদায়ের লোকেরা আশুরার নামে মূলত, যে কাজগুলো করছে তা শরীয়ত সম্মত নয়। তাদের উদ্দেশ্য মুসলমানদের মাঝে বিভ্রান্তি ছড়ানো। আর শিয়াদের প্রপাগাণ্ডায় আমরা এতবেশি প্রভাবিত হয়ে পড়েছি যে, মুহাররম তথা আশুরা আসলে আমরাও বিভিন্ন সেমিনার সিম্পোজিয়ামে আলোচনার মাহফিলে শুধু হায় হুসাইন! হায় হুসাইন! বলে নবীর এক সাহাবী তথা আহলে বায়তের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করতে গিয়ে নবীর আরেক জলীলুল কদর সাহাবী কাতিবে ওহী হযরত মুআবিয়া রাযি.-এর প্রতি বিষোদাগার করে নিজেদের আমল নষ্ট করে দেই। শুধু তাই নয় আমাদের আকীদা-বিশ্বাসও এমনভাবে নষ্ট হয়ে গেছে যে, মুহাররমের মত একটা মর্যাদাপূর্ণ ফযীলতের মাসে বিবাহের মত একটা উত্তম কাজ, এটার উপর আমল করতে আমরা দ্বিধাবোধ করছি।
প্রায়শঃই দেখা যায়, যে মুহাররম আসলে মানুষ জিজ্ঞেস করতে আসে- হুযূর! এটা তো মুহাররম মাস। এ মাসে বিয়ে-শাদীতে কোন অসুবিধা আছে কি? যখন তাকে পাল্টা প্রশ্ন করা হয়, অন্য সময় তো এমন জিজ্ঞেস করেন না, এখন জিজ্ঞেস করার কারণ কী? উত্তরে বলে, এ মাসে আশুরা নয়? তাকে বলা হয় আশুরা হলে অসুবিধা কী? উত্তর দেয়, কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা এ মাসে সংঘটিত হয়েছিল! এখন বিবাহ তো একটা ভাল কাজ, শুভ কাজ। এতে সারা জীবনের জন্য মানুষ একটা সুখ-শান্তি কামনা করে। এখন অশুভ মাসে শুভ কাজ কিভাবে করি! দেখুন, মানুষ কোত্থেকে কোথায় গেছে। এমনিভাবে কেউ কেউ তো মনে করে যে এদিনে কোন কিছু যবেহ করাও ঠিক নয়। এভাবে মানুষ একটা ফযীলতের দিনকে অশুভদিন বানিয়ে নিয়েছে এবং মনগড়া কিছু আচার- অনুষ্ঠান নির্ধারিত করে আশুরার মৌলিক শিক্ষা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে শুভবুদ্ধি দান কারুন এবং সহীহ দীনের উপর টিকে থাকবার তাওফীক্ব দিন! আমীন!
সম্মানিত বন্ধুগণ কম্পোজে কোন ভূল দৃষ্টিগোচর হলে অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন।

Thank you for reading the post.

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top