প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণ ও মুমিনের করণীয় । বিপদ-আপদ কেন আসে? । দুর্যোগের সময় মুমিনের করণিয় ।

Table of Contents

প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণ ও মুমিনের করণীয়:

الحمد لله وكفى وسلام على عباده الذين اصطفى أما بعد: فاعوذ بالله من الشيطان الرجيم- بسم الله الرحمن الرحيم

 {وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ بِشَيْءٍ مِنَ الْخَوْفِ وَالْجُوعِ وَنَقْصٍ مِنَ الأمْوَالِ وَالأنفُسِ والثَّمَرَاتِ وبشر الصابرينَ (١٠٥) الَّذِينَ إِذَا أَصَابَتْهُمْ مُصِيبَةٌ قَالُوا إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ (١٥٦) أُولئِكَ عَلَيْهِمْ صَلَوَاتٌ مِنْ رَبِّهِمْ وَرَحْمَةٌ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُهْتَدُونَ (١٥٧)) [البقرة: ١٥٥ – ١٥٧

عن أبي هريرة، قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: «مَنْ نَفْسَ عَنْ مُؤْمِنٍ كَرْبَةً مِنْ كَرَب الدُّنْيَا، نَفْسَ اللهُ عَنْهُ كُرْبَةً مِنْ كُرَب يَوْم الْقِيَامَةِ، وَمَنْ يَسَّرَ عَلى مُعْسِرٍ، يَسَّرَ اللهُ عَلَيْهِ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ، وَمَنْ سَتَرَ مسْلِمًا، سَتَرَهُ اللهُ في الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ، والله في عون العبد ما كان العبد في عون أخيه، صحيح مسلم (٢٠٧٤/٤)

ভূমিকা:

দুনিয়াতে মানুষের যেমন খুশি, আনন্দ ও সুখের উপলক্ষ আসে তেমনি আসে বিপদাপদ-মুসিবত ও দুঃখ বেদনার মূহুর্ত। এই নশ্বর দুনিয়ায় এমন কোন মানবের আবির্ভাব ঘটেনি যিনি সবসময় সুখ, শান্তি আর আনন্দ উপভোগ করে গেছেন। এমনকি নবীগণও এমন ছিলেন না। তারাও কঠিন কঠিন বিপদের সম্মুখীন হয়েছেন। তাই বিপদাপদ, বালা-মুসিবত, সুখ-দুঃখ মিলিয়েই মানুষের জীবন। এটিই দুনিয়ার বৈশিষ্ট্য। দুনিয়াকে আল্লাহ তায়ালা এভাবেই সাজিয়েছেন। তবে দুনিয়ার এই দুঃখ, কষ্ট বা আনন্দ উপভোগ সবই ক্ষণস্থায়ী। তাই দুনিয়ার কঠিন থেকে কঠিন বিপদে যেমন ভেঙ্গে পড়া বা নিরাশ হওয়া যাবে না তদ্রুপ কোন প্রাপ্তিতে (সুখের সময়) অত্মহারা ও অহংকারী হওয়া যাবে না।

বিপদ-আপদ কেন আসে?

মানুষের উপর আল্লাহ তায়ালা নানান কারণে বিপদাপদ ও বালা-মুসিবত দিয়ে থাকেন। নিম্নে আমরা কয়েকটি কারণ তুলে ধরছি।

১. পরীক্ষা স্বরূপ:

অনেক সময় বিপদাপদ দিয়ে বান্দাকে পরীক্ষা করা হয়। বান্দা বিপদে পড়ে আল্লাহর প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে কিনা? বান্দা ধৈর্যের পরিচয় দিতে পারে কিনা? আল্লাহর পথে নিজের জান-মাল বিলিয়ে দিতে রাজি কিনা ইত্যাদি বিষয় যাচাই-বাছাই করার জন্য আল্লাহ তায়ালা অনেক সময় বিপদাপদ, মুসিবত দিয়ে থাকেন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন,

}وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ بِشَيْءٍ مِنَ الخوف والجوع ونقص من الأموال والأنفُسِ وَالثَّمَرَاتِ وبشر الصابرين{ [البقرة: ١٥٥ – ١٥٧]

“আমি অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করবো কখনও কিছুটা ভয়-ভীতি দ্বারা, কখনও কিছুটা ক্ষুধা দ্বারা এবং কখনও জান-মাল ও ফল-ফসলের ক্ষয়ক্ষতি দ্বারা। সুসংবাদ দাও তাদেরকে যারা সবরের পরিচয় দেয়”। সূরা বাকারা ১৫৫ অন্য আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন,

وَبَلَوْنَاھُمْ بالْحَسَنَاتِ وَالسَّئِّئَاتِ لَعَلَّھُمْ یَرْجِعُوْن – الاعراف 168

“আমি তাদের ভাল মন্দ অবস্থা দ্বারা পরীক্ষা করি যাতে তারা সঠিক পথে ফিরে আসে।” সূরা আ’রাফ ১৬৮ ।

২. মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য:

অনেক সময় বিপদাপদ, মুসিবত ইত্যাদি দিয়ে আল্লাহ তায়ালা বান্দাদের নিজের প্রিয় বানিয়ে নেন এবং তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেন। এজন্য আল্লাহ তায়ালার কুদরতি নেযাম হলো, তিনি তার প্রিয় বান্দাদের থেকে বেশি বেশি পরীক্ষা নিয়ে থাকেন। বিভিন্ন বিপদাপদ, বালা-মুসিবত দিয়ে নানানভাবে তাদের পরীক্ষা করেন। হাদিস শরীফে এসেছে সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস রাযি. বলেন,

قلت: يا رسول الله أي الناس أشدُّ بلاء؟ قال: «الأنبياء، ثُمَّ الأمثل فالأمثل. حكم الألباني حسن صحيح

“আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! কোন মানুষের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা হয়? তিনি বলেন,নবীগণের। অতঃপর মর্যাদার দিক থেকে তাদের পরবর্তীদের, অতঃপর তাদের পরবর্তীদের “। সুনানে ইবনে মাজাহ ৪০২৩

৩.গোনাহের প্রাদুর্ভাব :

অনেক সময় গোনাহের কারণে আল্লাহর পক্ষ থেকে নানান মুসিবত ও বিপদাপদ যমীনে নেমে আসে। এসব বিপদাপদ মূলত মানুষের হাতের কামাই। মানুষের বদ আমলের কারণে আল্লাহ তায়ালা শান্তি স্বরূপ বালা-মুসিবত দিয়ে থাকেন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন,

{وَمَا أَصَابَكُمْ مِنْ مُصِيبَةٍ فَبِمَا كَسَبَتْ أَيْدِيكُمْ وَيَعْفُو عَنْ كَثير} [الشورى: ۳۰]

“তোমাদের যে বিপদ দেখা দেয়, তা তোমাদের নিজ হাতের কৃতকর্মেরই কারণে দেখা দেয়। আর তিনি তোমাদের অনেক কিছুই (অপরাধ) ক্ষমা করে দেন।” সূরা শূরা ৩০।

যেসব গোনাহ প্রকৃতিক দুর্যোগ আসার কারণ:

এমন অনেক গোনাহ রয়েছে যেগুলোর কারণে আল্লাহ পৃথিবীবাসীর উপর বন্যা,সুনামী,দুর্ভিক্ষ,মহামারী, অনাবৃষ্টি-অতিবৃষ্টি, ভূমিকম্প ও ভূমিধস, শাসকের যুলুমের মতো ভয়াবহ গজব নেমে আসে। নিম্নে আমরা এমন ভয়ঙ্কর কিছু গোনাহের কথা উল্লেখ করছি….

ক. আল্লাহর স্মরণ থেকে বিমূখতা ও তাঁর বিধিবিধান লঙ্ঘন করা:

আল্লাহ তায়ালার হুকুম-আহকাম ও বিধি- নিষেধ লঙ্ঘন করলে এবং আল্লাহর স্মরণ হতে উদাসীন হলে আল্লাহ তায়ালা দুনিয়াতে ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরী করে দেন। তখন দুনিয়াতে স্বাভাবিক জীবনযাপনের পরিবেশ থাকে না। পাশাপাশি আখিরাতেও এসব কারণে ভয়াবহ শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন,

{ وَمَنْ أَعْرَضَ عَنْ ذِكْرِي فَإِن له معيشة ضنكًا ونحشرہ يوم القيامةِ أَعْمٰى (١٢٤) قَالَ رَبِّ لِمَ حَشَرْتَنِي أَعْمٰى وَقَدْ كُنتُ بصِيرًا (۱۲۵) قال كذلك أتتك آياتنا فنسيتها وكذلك الْيَوْمَ تُنسى (١٢٦)

“যে আমার স্মরণ থেকে বিমূখ থাকবে, অবশ্যই তার জীবন-যাপন হবে সংকুচিত এবং আমি তাকে কিয়ামতের দিন উত্থিত করব অন্ধ অবস্থায়। সে বলবে হে আমার প্রতিপালক! আমাকে কেন অন্ধ অবস্থায় উঠালেন? আমি তো ছিলাম চাক্ষুষমান তিনি বলবেন এমনই তোমার কাছে আমার নিদর্শনাবলী এসেছিল কিন্তু তুমি তা ভুলে ছিলে। সেভাবেই আজ তুমিও বিস্মৃত হলে।” সূৱা ত্বহা ১২৪-১২৭ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম কুরতুবি রাহ: বলেন,

لا يُعْرِضْ أَحَدٌ عَنْ ذِكْرِ رَبِّهِ إِلَّا اظلم عليه وقته وتشوش عليهِ رِزْقُهُ، وَكَانَ فِي عِيشَةٍ ضنك.

“যে কেউ আল্লাহর স্মরণ হতে উদাসীন থাকে, যামানা তার উপর যুলুম করে, তার রিযিকে ঘাটতি দেখা দেয়, তার জীবন হয়ে পড়ে সংকুচিত।” তাফসিরে কুরতুবি ১১/২৫৯

খ. অঙ্গিকার ভঙ্গ করা ন্যায় বিচার না করা:

যে সমাজে অঙ্গিকার রক্ষা করা ও আদল-ইনসাফ ও কুরআনিক বিচার ব্যবস্থা না থাকবে, আল্লাহ সে সমাজে যালিম শাসক নিযুক্ত করে দিবেন। ফলে তাদের মাঝে মারামারি ও হানাহানির পরিবেশ তৈরী হবে। হাদিস শরীফে এসেছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

ولا حكم قوم بغير الحق إلا فنا فيهم الدم، ولا ختر قوم بالعَهْدِ إِلا سَلط عليهم العدو.

“যে জাতি ন্যায় বিচার করে না, তাদের মাঝে রক্তপাত বেশি হবে। আর যে জাতি চুক্তির খেলাফ করবে আল্লাহ তাদের উপর দুশমন (যালিম শাসক) চাপিয়ে দেন।” মুয়াত্তা মালেক ৯২৭

অন্য হাদিসে এসেছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

وَلَمْ يَنْقُضُوا عَهْدَ اللَّهِ، وَعَهْدَ رَسُولِهِ، إِلَّا سلط الله عليهمْ عَدُوًّا مِنْ غَيْرِهِمْ، فَأَخَذُوا بَعْض مَا فِي أَيْدِيهِمْ، وَمَا لَمْ تَحْكُمُ أَنمْتُهُمْ بِكِتَاب الله، ويتخيرُوا مِمَّا أنزل الله إِلَّا جَعَلَ اللَّهُ بَأْسَهُمْ بَيْنَهُمْ

“যখন কোন জাতি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অঙ্গীকার ভঙ্গ করে, তখন আল্লাহ তাদের উপর তাদের বিজাতীয় দুশমনকে ক্ষমতাসীন করেন এবং সে তাদের সহায়-সম্পদ সবকিছু কেড়ে নেন। যখন তোমাদের শাসকবর্গ আল্লাহর কিতাব মোতাবেক ফয়সালা করে না এবং আল্লাহর নাযিলকৃত বিধানকে গ্রহন করে না, তখন আল্লাহ তাদের পরস্পরের মাঝে যুদ্ধ বাধিয়ে দেন।” সুনানে ইবনু মাজাহ ৪০১৯ (হাসান)

গ. যাকাত না দেওয়া:

সমাজের বিত্তশালীরা যাকাত না দিলে আল্লাহর পক্ষ থেকে বৃষ্টি বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফলে খাদ্যের সংকট তৈরী হয় এবং দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। হাদিস শরীফে এসেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

وَلَا مَنْعَ قَوْمُ الزَّكَاةَ، إِلَّا حَيْسَ الله عَنْهُمُ القَطرَ» التعليق . من تشخيص الذهبي ٩٥٧٧ . على شرط مسلم

“যে সম্প্রদায় যাকাত দিতে অস্বীকার করবে, আল্লাহ তায়ালা তাদের জন্য বৃষ্টি বন্ধ করে দিবেন” । আল মুসতাদরাক লিল হাকিম २

অন্য হাদিসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

وَلَمْ يَمْنَعُوا زَكَاة أَمْوَالِهِمْ إِلَّا مُنعُوا القطر مِنَ السَّمَاءِ، وَلَوْلَا الْبَهَائِمُ لَمْ يُمْطَرُوا.

“যখন যাকাত আদায় না করে তখন আসমান থেকে বৃষ্টি বর্ষণ বন্ধ করে দেওয়া হয়। যদি ভূ-পৃষ্ঠে চতুষ্পদ জন্তু ও নির্বাক প্রাণী না থাকতো তাহলে আর কখনো বৃষ্টি হতো না”। সুনানে ইবনু মাজাহ ৪০১৯ হাসান

ঘ. যিনা-ব্যাভিচার ও বেহায়াপনা বৃদ্ধি পাওয়া :

যখন যিনা, ব্যাভিচার ও অশ্লীলতা বেড়ে যাবে তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে শাস্তি হিসেবে সমাজে মহামারী ও নতুন নতুন রোগের অবির্ভাব ঘটবে। হাদিস শরীফে এসেছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

لم تظهر الفاحشة في قزم قط حتى يغللوا بها إلا فتنا فيهم الطَّاعُونَ، وَالأوجاع التي لم تَكُنْ مَضَتْ فِي أَسْلَافِهِمْ الَّذِينَ مضواء

“যখন কোন জাতির মধ্যে প্রকাশ্যে অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ে তখন সেখানে মহামারী আকারে প্রেগরোগের প্রাদুর্ভাব হয়। তাছাড়া এমন সব ব্যাধির উদ্ভব হয়, যা পূর্বেকার লোকদের মাধ্যে কখনো দেখা যায়নি” । সুনানে ইবনু মাজাহ ৪০১৯ হাসান

অন্য হাদিসে এসছে যিনা ব্যাভিচারের প্রাদুর্ভাবে শাস্তি স্বরূপ হতাহত ও মৃতের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যে জাতির মধ্যে যিনা

বেশি হয়, তাদের মধ্যে মৃত্যুর আধিক্য ঘটে” । মুয়াত্তা মালেক ১৯২৭

ঙ. সুদি লেনদেন করা:

সুদি লেনদেনের কারণে সমাজে আল্লাহর গজব ও বিপদ-আপদ নেমে আসে। হাদিস শরীফে এসেছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

مَا مِنْ قَوْمٍ يَظْهَرْ فِيهِمُ الزنا، إلا أخذُوا بالمئة، وما مِنْ قَوْمٍ يظهر فيهم الرُّشا، إِلَّا أَخِذُوا بِالرُّعْب

“যে জাতির মাঝে সুদি কারবার প্রকাশ পায় তাদেরকে দুর্ভিক্ষে নিপতিত হয়। যে জাতি ঘুস আদান প্রদান করে তাদের মনে দুশমনের ভয় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়।” মুসনাদে আহমাদ ১৭৮২২ পরীক্ষ

আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রাযি. বলেন,

قال ابن عباس: ولا كثر الرب في قوم الأسلط الله عليهم الوباء.

“যে সম্প্রদায়ে সুদি লেনদেনের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় তাদের উপর বিপদাপদ, বালা-মুসিবত চাপিয়ে দেওয়া

হয়” উমাদাতুল কারী ৫/১৮০

চ. ওজনে কম দেওয়া:

মানুষকে ওজনে কম দেওয়া ও বা প্রতারণা করা ভয়াবহ একটি অপরাধ। এ অপরাধের করণে শাসকের যুলুমসহ আরো অনেক মুসিবত দুনিয়াতে নেমে আসে। হাদিস শরীফে এসেছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

وَلَمْ يَنقُصُوا المِكْيَالَ والميزان، إلا أخذوا بالسنين، وتبدةِ المَدُّونَةِ، وَجَوْرِ السَّلطَان عَلَيْهِمْ

“যখন কোন জাতি ওজন ও পরিমাপে কারচুপি করে তখন তাদের উপর দুর্ভিক্ষ, কঠিন বিপদ-মুসিবত ও শাসকের যুলুম নেমে আসে।” সুনানে ইবনু মাজাহ ৪০১৯ হাসান

অন্য হাদিসে এসেছে পরিমাপ নিয়ে প্রতারণার কারণে বৃষ্টি বন্ধ করে দেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লাম বলেন, وَلا نقص قوم المکیال والمیزان الا قطع عنھم القطر ” যে জাতি মাপে কম দেয় আল্লাহ তাদের রিযিক

কমিয়ে দেন।” মুয়াত্তা মালেক ১৯২৭

প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণ ও মুমিনের করণীয় । বিপদ-আপদ কেন আসে? । দুর্যোগের সময় মুমিনের করণিয় ।

১. গোনাহ ছেড়ে তাওবা করা

প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় অন্যতম একটি আমল হলো আল্লাহ তায়ালার নিটক বেশি বেশি তাওবা করা। আমল করার মাধ্যমে ক্ষয়ক্ষতি থেকে বাঁচার সুযোগ রয়েছে। হাদিস শরীফে আছে, যখন কোথাও ভূমিকম্প সংঘটিত হয় অথবা সূর্যগ্রহণ হয়, ঝোড়ো বাতাস বা বন্যা হয়, তখন সবার উচিত মহান আল্লাহর কাছে তওবা করা, তাঁর কাছে নিরাপত্তার জন্য দোয়া করা, মহান আল্লাহকে স্মরণ করা এবং ক্ষমা প্রর্থনা করা। হাদিস শরীফে এসেছে এসব ক্ষেত্রে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লাম বলতেন,

فَافْزَعُوا إِلَى ذِكْرِهِ وَدُعَائِهِ وَاسْتِغْفَارِهِ»

তোমরা দ্রুততার সঙ্গে আল্লাহকে স্মরণ করো, তাঁর নিকট তওবা করো।” সহিহ বুখারি ১০৫৯

২. দোয়া করা:

বৃষ্টির সময় দোয়া পড়া কেননা, একদিকে বৃষ্টি যেমন রহমত, আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে আযাব ও হতে পারে। এ কারণে রাসূল সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম বৃষ্টি দেখলেই মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে উপকারী বৃষ্টির জন্য দোয়া করতেন। হাদিস শরীফে এসেছে হযরত আয়েশা রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন বৃষ্টি হতো তখন রাসূল সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেন- اللّٰھمَّ صیّبًا نافعۃ “হে আল্লাহ! আপনি যে বৃষ্টি দিচ্ছেন, তা যেন আমাদের জন্য উপকারি হয়”। সহিহ বুখারি ১০৩২ তদ্রুপ অতি বৃষ্টি বন্ধের জন্য আল্লাহ তায়ালার কাছে দোয়া করা। হযরত আনাস ইবনে মালেক রাযি. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন,

بَيْنَمَا رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَخْطُبُ يَوْمَ الجُمُعَةِ، إِذْ جَاءَهُ رَجُلٌ، فَقَالَ: يَا رَسُولَ اللهِ قحط المَطَرُ، فَادْعُ اللهَ أَنْ يستغينا، فَدَعَا فَمُطِرْنَا، فَمَا كدنا أن نصل إلى منازلنا فما زلنا ننظر إلى الجمعة المقبلة، قال: فَقَامَ ذلكَ الرَّجُلُ أَوْ غَيْرُهُ فقال: یا رسول الله ادْعُ الله أن يصرفه عنا، فَقَالَ رَسُول الله صلى الله عليه وسلّم: «اللهم حَوَالَيْنَا وَلَا عَلَيْنَا قَالَ: فَلَقَدْ رأيت السحاب يتقطَّعْ يمينا وشمالا، يمطرُونَ وَلَا يُمْطرُ أَهْل المدينة.

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জুমার খুত্বা দিচ্ছিলেন, এমন সময় একজন লোক এসে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ বৃষ্টি বন্ধ হয়ে গেছে আপনি বৃষ্টির জন্য দোয়া করুন, তিনি যেন আমাদের বৃষ্টি দান করেন। তখন তিনি দোয়া করলেন, ফলে এত বেশি বৃষ্টি হলো যে, আমাদের নিজ নিজ ঘরে পৌঁছতে পারছিলাম না। এমন কি পরের জুমা পর্যন্ত বৃষ্টি হতে থাকল। আনাস রাযি. বলেন তখন সে লোকাটি বা অন্য একজন লোক দাঁড়িয়ে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ আপনি দোয়া করুন, আল্লাহ যেন আমাদের উপর থেকে বৃষ্টি সরিয়ে দেন। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন হে আল্লাহ! আমাদের আশে পাশে আমাদের উপর নয়, আনাস রাযি. বলেন, আমি তখন দেখলাম মেঘ ডানে ও বামে বিভক্ত হয়ে বৃষ্টি হতে লাগল। মদিনা বাসীর উপর বর্ষন হচ্ছিল না। (সহীহ বুখারী ১০১৫)

দুর্যোগ কালীন সময়ে ধ্বংসের হাত থেকে বাচার জন্যও আল্লাহ কাছে এ সময় বেশি বেশি দোয়া করতে থাকা। হাদিস শরীফে এসেছে যখন বজ্রপাত ও বিজলি ইত্যাদি চমকাতো তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেন,

اَللّٰهمَّ لَا تَقْتلنا بغضبك، ولا تهلكنا بِعَذَابِكَ، وَعَاقِنَا قَبْلَ ذَلِكَ.

” হে আল্লাহ! গযব দিয়ে আমাদের নিঃশেষ করবেন না, আযাব দিয়ে আমাদের ধ্বংস করবেন না; এর পূর্বেই আমাদের ক্ষমা করে দিন। সুনানে তিরমিযী ৩৪৫০

৩. সবর করা :

মুসিবতের সময় সবচেয়ে বড় আমল হল, ধৈর্য ধারণ করা। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন,

وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ بِشَيْءٍ مِنَ الْخَوْفِ وَالْجُوعِ وَنَقْصٍ مِنَ الأمْوَالِ وَالأنفُسِ والثَّمرات وبشر الصابرين (١٥٥) الَّذِينَ إِذَا أَصَابَتْهُمْ مُصِيبَةٌ قَالُوا إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ (١٥٦) أولئكَ عَلَيْهِمْ صَلَوَاتٌ مِنْ رَبِّهِمْ وَرَحْمَةٌ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُهْتَدُونَ (١٥٧

“আমি অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করবো কখনও কিছুটা ভয়-ভীতি দ্বারা, কখনও কিছুটা ক্ষুধা দ্বারা এবং কখনও জান-মাল ও ফল-ফসলের ক্ষয়ক্ষতি দ্বারা। সুসংবাদ দাও তাদেরকে যারা সবরের পরিচয় দেয়। যারা কোনো মুসিবত দেখা দিলে বলে ওঠে, ‘ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাযিউন’ অর্থাৎ আমরা সকলে আল্লাহরই এবং আমাদেরকে তাঁর কাছেই ফিরে যেতে হবে। এরাই তারা, যাদের প্রতি তাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে বিশেষ করুণা ও দয়া রয়েছে এবং এরাই আছে হিদায়াতের উপর”। সূরা বাকারা ১৫৫-১৫৭

অপর আয়াতে লুকমান আ. তাঁর ছেলেকে দেওয়া সবরের উপদেশ বর্ণনা করে আল্লাহ তায়ালা বলেন,

يابني أقم الصَّلاةَ وَأَمْرُ بالمَعْرُوفِ وَاله عن المنكر واصبر على ما أصابك إن ذلك مِنْ عَزْمِ الْأُمور} [لقمان: ١٧]

“লুকমান আ. ছেলেকে বললেন, হে বৎস! সালাত কায়েম কর, সৎ কর্মের নির্দেশ দাও আর অসৎ কর্মে নিষেধ কর এবং আপদে বিপদে ধৈর্য ধারণ কর। এটিই দৃঢ় সংকল্পের কাজ”। সূরা লুকমান ১৭

তাই বিপদাপদে কুরআনের নির্দেশ হল, ধৈর্য ধারণ করা। ধৈর্যের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার কাছ থেকে প্রতিদান নেয়া। ধৈর্যের প্রতিদান বর্ণনা করে আল্লাহ তায়ালা বলেন,  انما یوفی الصابرون اجرھم بغیر حساب“যারা সবর অবলম্বন করে তাদেরকে সওয়াব দেওয়া হবে অপরিমিত। ” সূরা যুমার ১০

হাদিস শরীফে এসছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, والصبرُ ثوابہ الجنّۃ “সবরের প্রতিদান হল কেবলই জান্নাত।” জয়াবুল ঈমান ৩৩৩৬

৪.রুজু ইলাল্লাহ:

বিপদাপদে মানুষ আল্লাহ তায়ালাকে বেশি বেশি স্মরণ করে। রুজু ইল্লাল্লাহ বেশি হয়। এজন্য আল্লাহ তায়ালা চান বিপদে পড়ে হলেও বান্দা যেন তাঁর দিকে ফিরে আসে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, [ وَبَلَوْنَاھُمْ بالْحَسَنَاتِ وَالسَّئِّئَاتِ لَعَلَّھُمْ یَرْجِعُوْن – الاعراف 168) “আমি তাদের ভাল মন্দ অবস্থা দ্বারা পরীক্ষা করি যাতে তারা আমার পথে ফিরে আসে।” সূরা আ’রাফ ১৬৮

৫. তাকদিরের উপর সমর্পন করা:

প্রতিটি মুমিনের জন্য একথা বিশ্বাস করা জরুরী যে, দুনিয়াতে যা কিছু ঘটে তা লওহে মাহফুযে লিখিত সেই তাকদির অনুযায়ীই ঘটে। তাই মুমিন বিপদাপদে হাল ছেড়ে দেয় না, আবার কোন খুশির ঘটনা ঘটলে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ে না। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন,

(۲۲) مَا أَصَابَ مِنْ مُصِيبَةٍ فِي الْأَرْضِ وَلا في انفسكم إلا في كِتَابِ مِنْ قَبْل أن نَبْرَأهَا إِنَّ ذَلِكَ عَلَى اللهِ يَسيرٌ ـ لِكَيْلَا تأْسَوْا عَلَى مَا فَاتَكُمْ وَلا تَفْرَحُوا بما آتَاكُمْ وَالله لا يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُور [الحديد: ۲۲، ۲۳]

“দুনিয়াতে অথবা তোমাদের নিজেদের উপর যে সব মুসিবত আসে আমি তা সংঘটিত করার পূর্বেই লওহে মাহফুযে লিপিবদ্ধ থাকে। আল্লাহ তায়ালার পক্ষে তা খুবই সহজ। তা এজন্য যে, তোমরা যা হারিয়েছ, তার জন্য যেন দুঃখিত না হও এবং যা আল্লাহ তোমাদের দান করেছেন তার জন্য উল্লসিত না হও। আল্লাহ তায়ালা এমন ব্যক্তিকে পছন্দ করেন না যে দর্প দেখায় ও বড়ত্ব প্রকাশ করে। ” সূরা হাদীদ ২১-২২

একজন মুসলমানের বড় হাতিয়ার হল তাকদির:

মুসলমানদের সর্বশেষ ও সবচেয়ে শক্তিশালী আশ্রয় এবং সান্তনা হলো তাকদিরের প্রতি বিশ্বাস। ভালো-মন্দ সবই আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়, এর প্রতি বিশ্বাস রাখা। এটি ঈমানের মৌলিক একটি বিষয়। তাকদিরের এই বিশ্বাসের ফলে মুমিন যে কোন ধরনের বালা-মুসিবতে এতটা দুঃখিত হয় না যে, সেই দুঃখ তার স্থায়ী অশান্তি বা পেরেশানীর কারণ হবে। বরং মুমিন এই ভেবে সান্তনা লাভ করে যে, তাকদিরে যা লিখা ছিল তাই হয়েছে। পাশাপাশি মুমিন বিশ্বাস করে এটি তো দুনিয়ার কষ্ট, দুনিয়ার কোন কিছুই চিরস্থায়ী নয়। এই ভেবে একজন মুমিন শত বিপদেও প্রশান্তি খোঁজে পায়। শত কষ্টেও মুমিন ভেঙ্গে পড়েনা, নিরাশ হয় না। তাকদিরের এই শিক্ষার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা নৈরাশ্যপনা থেকে মুসলমাদের মুক্তি দিয়েছেন। কারণ নিরাশ হলে মানুষের গতিবিদি ঠিক থাকে না। অনেক সময় মানুষ নিরাশ হয়ে আত্মহত্যার মত জঘন্য পথ বেছে নেয়। আল্লাহ তায়ালা তাকদিরের বদৌলতে মুসলিম উম্মাহকে এই মহাপিবদ

থেকে হেফজত করেছেন।

৬. দুর্যোগ কবলিত ব্যক্তিদের সাহায্যে এগিয়ে আসা:

বন্যা-দুর্গতদের সাহায্যে এগিয়ে আসা, সামর্থ্য অনুযায়ী তাদের সহযোগিতা করা বর্তমান সময়ের গুরুত্বপূর্ণ একটি ঈমানী দায়িত্ব। একজন মুসলিম অপর ভাইয়ের বিপদ দূর করার জন্য সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে করবে এটি ঈমান ও ইসলামের দাবী। এ সংক্রান্ত কয়েকটি হাদিস আমার তুলে ধরছি..

ক. মুমিনের বিপদ দূর করে দিলে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা বিপদ দূর করে দিবেন। হাদিস শরীফে এসেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

مَنْ كَانَ فِي حَاجَةٍ أَخِيهِ كَانَ اللهُ فِي حَاجَتِهِ، وَمَنْ فَرَّجَ عَنْ مُسلِم كربة فرج الله عنه كربة مِنْ كَرُبَاتِ يَوْمِ الْقِيَامَةِ، وَمَنْ ستر مسلمًا سَتَرَهُ اللَّهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ»

“যে কেউ তার মুসলিম ভাইয়ের প্রয়োজন পূরণ করবে আল্লাহ তার প্রয়োজন পূরণ করে দিবেন। যে কেউ তার মুসলিম ভাইয়ের বিপদ দূর করে দিবে আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের দিন তার বিপদসমূহ দূর করে দিবেন। যে ব্যক্তি কোন মুসলমানের দোষ ঢেকে রাখবে, আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের দিন তার দোষ ঢেকে রাখবেন।” সহিহ বুখারি ২৪৪২

খ. মুমিনের সাহযোগিতায় লিপ্ত ব্যক্তিকে আল্লাহ তায়ালা কুরদরতীভাবে সাহায্য করে থাকেন। হাদিস শরীফে এসেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

والله في عون العَبْدِ مَا كَانَ الْعَبْدُ فِي عَوْنِ أَخِيهِ

‘বান্দা যতক্ষণ তার ভাই-এর সহযোগিতায় আনত্মনিয়োগ আল্লাহ ততক্ষণ তার সহযোগিতা করতে থাকেন” সহিহ মুসলিম ২৬৯৯

গ. বিপদগ্রস্তদের প্রতি দয়া করলে আল্লাহ তার উপর দয়া করেন। হাদিস শরীফে এসেছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«الرَّاحِمُونَ يَرْحَمُهُمُ الرَّحْمَنُ ارْحَمُوا أَهْلَ الْأَرْضِ يَرْحَمُكُمْ مَنْ فِي السَّمَاءِ»

“দয়াশীলদের ওপর করুণাময় আল্লাহ দয়া করেন। তোমরা দুনিয়াবাসীকে দয়া করো, তাহলে যিনি আসমানে আছেন তিনি তোমাদের দয়া করবেন। সুনানে আবি দাউন ৪৯৪১

ঘ. আল্লাহ তায়ালা মুমিন জাতিকে এক দেহের মতো বানিয়েছেন। ফলে দেহের কোনো অংশ বিপদে পড়লে অন্য অংশ স্বস্তিতে থাকতে পারে না। হাদিস শরীফে এসেছে রাসূল সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

مثَلُ الْمُؤْمِنينَ في تَوَادِهِمْ، وَتَرَاحْمِهمْ، وتعاطفهم مثل الجسد إذا اشتكى منه عضو تداعى له سائرُ الْجَسَندِ بالشهر وَالْحُمَّى

“পারস্পরিক ভালবাসা, দয়াদ্রতা ও সহানুভূতির দিক থেকে সকল মুমিন একটি মানবদেহের মত। যখন একটি অঙ্গ আক্রান্ত হয় তখন তার সমস্ত দেহে উত্তাপ ও বিনিদ্রা চলে আসে।” সহীহ মুসলিম ২৫৮৬

তাই আমরা আমাদের বন্যাকবলিত ভাই-বোনদের বিপদের মধ্যে রেখে স্বস্তিতে থাকতে পারি না। আমাদের প্রত্যেকেরই দায়িত্ব বন্যাদুর্গতদের সাহায্যে এগিয়ে আসা। যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী চেষ্টা করা। তাদের জন্য প্রয়োজনীয় ত্রাণসামগ্রী, খাদ্য, বস্ত্র, ওষুধ, খাবার স্যালাইন ও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে তারা যেন পরিবার নিয়ে পর্দা রক্ষা করে নিরাপদে থাকতে পারে, সে জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

৫. দুস্থদের সাহায্য করার বিশেষ একটি ফায়দা হলো, এতে মহান আল্লাহর সাহায্য পাওয়া যায়। যারা দুস্থদের সহযোগিতা করে আল্লাহ তায়ালা দুনিয়া ও আখিরাতে তাদের সম্মান রক্ষা করবেন। প্রথম ওহি আসার পর যখন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন নিজের ব্যাপারে শঙ্কা বোধ করলেন, তখন খাদিজা রাখি, তাঁকে অভয় দিয়ে বলেন,

وَاللَّهِ مَا يُخْزِيكَ اللَّهُ أَبَدًا، إِنَّكَ لتصل الرحم، وتحمل الكل، وتكسب المَعْدُوم، وتقري الصيف، وَتُعِينُ عَلى نَوَائِبِ الحَقِّ،

“আল্লাহ আপনাকে কখনো লাঞ্ছিত করবেন না। আপনি তো আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সদাচরণ করেন, অসহায় দুস্থদের দায়িত্ব বহন করেন, নিঃস্বকে সহযোগিতা করেন, মেহমানের আপ্যায়ন করেন এবং হক পথের দুর্দশাগ্রস্তকে সাহায্য করেন। সহিহ বুখারি ৩।

চ. একজন অসহায়ের সাহায্যে পথ চলা এক মাস ইতিকাফ করার চেয়েও উত্তম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

ولأن أمشي مع أخ في حَاجَة أحب إلي من أن أعتكف في هذا المسجد يعني مسجد المدينة شهرا. حسنه الألباني في صحيح الترغيب

“এই মসজিদ (মসজিদে নববী)-এ একমাস ইতিকাফ করার চেয়ে আমার কাছে প্রিয় হলো একজন বিপদগ্রস্থ ভাইয়ের সাহয্যে চলাফেরা করা”। আক্তারগীব ওয়াত তারহীব ৩৯৮৫ হাসান

ছ. বন্যা দুর্গতদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়ালে আমাদের প্রতি আল্লাহ তায়ালা সন্তুষ্ট হবেন এবং আল্লাহ তায়ালার ক্রোধ প্রশমিত হবে, পাশাপশি আমাদের উপর থেকে বালা-মুসিবত দূর হয়ে যাবে। হাদিস শরীফে এসেছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«إِنَّ الصَّدَقَةُ الفِي غَضَبَ الرَّبِّ وَتَدْفَعُ مِيتة السوء

” নিশ্চয়ই দান-সাদাকা আল্লাহর ক্রোধ প্রশমিত করে এবং অপমানজনক মৃত্যু রোধ করে।” সুনানে তিরমিঘী

বিপদাপদে মুমিনের উপকার:

মুমিন দুনিয়াতে বিভিন্ন সময় বিপদাপদে আর মুসিবতে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। ফলে অনেক দুঃখ কষ্ট ও পেরেশানীর সম্মুখীন হয়। যদিও বাহ্যিকভাবে এগুলোতে মুমিনের কষ্ট হয়। কিন্তু এসবের মাধ্যমে মুমিনের অনেক মতবা বুলন্দ হয়। কেননা মুমিনের ছোট থেকে ছোট মুসিবত আর কষ্টগুলো পূণ্য থেকে খালি নয় বরং প্রতিটি কষ্ট ও পেরেশানীর বিনিময়ে মুমিন সাওয়াব হাসিল করে এবং গোনাহ থেকে মুক্তি লাভ করে। হাদিস শরীফে এসেছে আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ রাযি. বলেন,

أتيت النبي صلى الله عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي مَرَضِهِ، وَهُوَ يُوعَك وعكا شديدًا، وقلت: إنك لتوعك وعَكًا شَدِيدًا، قُلْتُ: إِنْ ذَاكَ بِأَنَّ لك آخرين؟ قال: «أجَلْ، مَا مِنْ مُسْلِمٍ يُصِيبُهُ أذى إلا حاث الله عنه خطاياه، كَمَا تَحَاتُ وَرَقُ الشَّجَرِ»

“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অসুস্থতার সময় তাঁর কাছে গেলাম। এ সময় তিনি ভীষণ জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিলেন। আমি বললাম, নিশ্চয়ই আপনি ভীষণ জ্বরে আক্রান্ত। এমি এও বললাম, এটি এজন্য যে, আপনার জন্য দ্বিগুণ সাওয়ার। তিনি বললেন হ্যাঁ। যে কেউ রোগাক্রান্ত হয়, তার থেকে গোনাহ সমূহ এমনভাবে ঝরে যায়, যেভাবে গাছ হতে তার পাতাগুলো ঝরে যায়।” সহিহ বুখারি ৫৬৪৭

অন্য হাদিসে এসেছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«مَا مِنْ مُسْلِمٍ يُشَاكَ شَوْكَةً فَما فوقها إلا كتبت له بها درجةً، وَمُحِيَتْ عَنْهُ بِهَا خَطِيئَةٌ)

“কোন মুসলিমের গায়ে একটি কাঁটা বিদ্ধ হলে কিংবা এর চেয়েও আরও ছোট্ট কোন আঘাত লাগলে, তার বিনিময়ে তার একটি মর্যাদা বৃদ্ধি পায় এবং তার একটি গোনাহ মাফ করে দেওয়া হয়” সহিহ মুসলিম ২৫৭ হযরত আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত অপর এক হাদিসে এসেছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, یزال البلاء بالمؤمن والمؤمنۃ فی نفسہ وولدہ ومالہ یلعّی اللہ وما علیہ خطئۃ “মুমিন নারী-পুরুষের উপর, তার সন্তানের উপর ও তার ধন-সম্পদের উপর অনবরত বিপদাপদ লেগেই থাকে সবশেষে আল্লাহ তায়ালার সাথে সে গোনাহমুক্ত অবস্থায় মিলিত হয়।” সুনানে তিরমিধী ২৩৯৯

বিপদ-আপদ আখিরাতের স্মরণিকা

মুহতারাম হাযিরীন। দুনিয়ার এই ক্ষণস্থায়ী বিপদাপদ আমাদের আখিরাতের ভয়াবহ ও স্থায়ী বিপদকে স্মরণ করিয়ে দেয়। দুনিয়াতে বিপদে পড়লে অনেকেই আমাদের সাহয্যে এগিয়ে আসে। নিজের পিতা-মাতা, সন্তান- সম্প্রতি,আত্মীয়-স্বজন সর্বোচ্চ শক্তি-সামর্থ্য নিয়ে পাশে থাকে। কিন্তু আখিরাতের বিপদ আর মুসিবত পেয়ে বসলে কেউ সাহায্যে এগিয়ে আসবে না। এমনকি পরিচিতজনরা নিজের পরিচয় গোপন করে পালাবে। সেই ভয়াবহ পরিস্থিতি বর্ণনা করে আল্লাহ তায়ালা বলেন,

یوم یفرّ المرء من اخیہ – وامّہ وابیہ – وصاحبتہ و بنیہ – لکلّ امرئٍ منھم یومئذ شان یغنیہ – عبس – 34

“সেদিন মানুষ তার ভাই থেকে পালাবে। নিজ পিতা-মাতা থেকেও পালাবে। নিজ স্ত্রী-সন্তান সন্ততি থেকেও পালাবে। কেননা সেদিন প্রত্যেকের এমন দুশ্চিন্তা দেখা দিবে, যা তাকে অন্যের থেকে ব্যস্ত করে রাখবে। ” সূরা আবাসা ৩৪-৩१

তাই, আমাদের কাজ হবে দুনিয়ার এই ছোট মুসিবত থেকে শিক্ষা নিয়ে অখিরাতের মুসিবতে যেন আমরা কেউ না পড়ি সেজন্য সর্বোচ্চ সতর্ক থাকা। খোদার নাফরমানী থেকে একেবারেই নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া। আল্লাহ তায়ালার কাছে গোনাহ মুক্ত থাকার জন্য সাহায্য চাওয়া ও অতীতের গোনাহের জন্য তাওবা করা।

শেষকথা:

আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে বন্যা-দুর্গতদের সাহায্যে এগিয়ে আসার তাওফিক দান করুন। আমাদেরকে দুনিয়া আখিরাতের ছোট বড় সব ধরনের বিপদ-আপদ থেকে হেফাজত করুন। আমীন! ইয়া রাব্বাল আলামীন।

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top